করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে রাজধানীর কেরানীগঞ্জের গার্মেন্টস একধরনের ভঙ্গুর দশায় চলে গিয়েছিল। তবে বড় ধরনের অস্থিরতা না থাকায় গত বছর ব্যবসায়ীরা সে অবস্থা কাটিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ৫ জানুয়ারি থেকে সরকার ও বিরোধী দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে এবং গত ২৮ অক্টোবর কার্যত অচল ছিল ঢাকাসহ সারাদেশ। জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিরোধী দলগুলোর হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি এ সংকটকে করছে ঘনীভূত। রাজনীতির এমন অনিশ্চিত যাত্রা চলতে থাকলে অর্থনীতিতে আরও বড় ধাক্কা লাগতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনায় সারাবিশ্বের অর্থনীতি মারাত্মক চাপে পড়েছিল। এরপর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম। গেল এক বছরে দফায় দফায় বেড়েছে ডলারের দাম। অনেক ব্যাংক ঋণপত্র (এলসি) খুলতে চাচ্ছে না। এতে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
নোভা গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম বাবলু বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা কেরানীগঞ্জ গামেন্টসখাতে বড় ধরনের সঙ্কটের সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন, গত করোনার পর এক বছর আমরা অপেক্ষাকৃত শান্তিতেই ছিলাম। আমরা যে ক্ষতির শিকার হয়েছিলাম, তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। ক্রেতারা আবার ফিরতে শুরু করছিলো। কিন্তু এখন আবার রাজনৈতিক অঙ্গনে যেসব বিশৃঙ্খলা হচ্ছে, তা আমাদের চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে গড়ে প্রতিদিন পোশাক শিল্পেই প্রায় কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
সিয়াম গার্মেন্টসে স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক দল বিএনপি নানা কর্মসূচি ঘোষণা করছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর পল্টনে নেতাকর্মীদের মধ্যে যে সংঘর্ষ তার জেরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে এমনটাই ধারনা করা যায়। রাজনীতিকদের উচিত পোশাক শিল্পের বিষয়ে নজর রাখা।
পাইকারি পাঞ্জাবী পায়জামা প্রস্তুতকারক শেখ সাদী গার্মেন্টসের ম্যানেজার রেজাউল হক বলেন, শ্রমিকরা রাজনীতি বোঝেন না। পেটের দায়ে কাজ করেন তারা। দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাতে সর্বোচ্চ কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়, এটাই বাস্তবতা। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসায় ক্ষতি হয়। শিপমেন্ট বাতিল হয়, অর্ডার চলে যায়। বেতন বন্ধ হয় শ্রমিকদের, বিপদে পড়েন তারা। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে শেষ না করলে তার দায় নিতে হয় জনগণকে।
অবরোধে গাড়ি ভাড়া বেড়েছে উল্লেখ করে যশোর থেকে আসা কাজল বস্ত্রালয়ের স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও কর্মকাণ্ডের কারণে অনেক গাড়ি ভয়ে রাস্তায় নামতে চায় না। যেসব ট্রাক ঝুঁকি নিয়ে পণ্য পরিবহন করছে, তারা আগের চেয়ে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে। এটি ব্যবসায়ীদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। কারণ এতে পণ্যের খরচ বেড়েছে। যার প্রভাব পড়বে দামে।
‘স্মার্ট’ জোনের কর্ণধার দিদার হোসেন বলেন, শীতের বাজার ঘিরে অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছি। অক্টোবর-নভেম্বরে ব্যস্ত সময় পার করতে হয় আমাদের। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতার আতঙ্কে ক্রেতারা আসছেন না। এভাবে চললে ভরা মৌসুমে আমাদের ব্যবসা হারাতে হবে।
এদিকে, সর্বশেষ অক্টোবরে রপ্তানি কমেছে ১৪ শতাংশ। রেমিট্যান্স অক্টোবরে বাড়লেও এর আগের তিন মাসে কমেছে। শিল্পের কাঁচামাল এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে, যা বিনিয়োগে ধীরগতির লক্ষণ। সর্বশেষ শ্রম জরিপে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার তথ্য রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় সরবরাহ, উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানিসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হলে সংকট আরও বাড়বে।
কেরানীগঞ্জের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুসলিম ঢালী জানান, একদিন হরতাল দিলে কোটি টাকার ক্ষতি হয়। অবরোধের ক্ষতির অঙ্কটাও বিশাল হচ্ছে। অবরোধে দোকানপাট খোলা থাকলেও ক্রেতা থাকে কম। কিছু বেচাকেনা হলেও অন্তত কোটি টাকার ক্ষতি হয় এক দিনের অবরোধে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক হোসাইন আল সিকদার বলেন, সংঘাতময় রাজনীতি অর্থনীতিকে বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। নির্বাচনের ব্যাপারে শান্তিপূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এ পরিস্থিতি হয়তো চলতে থাকবে, যার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিণাম হবে ভয়াবহ। তবে এখন পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের মনোভাবে নমনীয়তার লক্ষণ নেই। কয়েক দিন ধরে যেভাবে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ, ডলার সংকট ও কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও সংকুচিত হবে। অর্থনীতির সব খাতেই তৈরি হবে একটা বিরূপ পরিস্থিতি।
এমএইচ