হবিগঞ্জে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে নদী, খাল, বিল এবং হাওরে যখন বর্ষার নতুন পানিতে টইটম্বুর তখন মাছ শিকারের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বর্ষার এ মৌসুমে জেলেদের আশা মাছও ধরা পড়বে বেশি। তবে এ বছর সেই আশায় ভাটা পড়েছে জেলেদের ভাগ্যে। জেলেরা মাছ ধরতে নামলেও আশানুরূপ মাছ না পেয়ে খালি হাতে ফিরছেন। এতে সংকটে পড়েছে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা জেলে পরিবারগুলো।
হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জের সদর ইউনিয়নের নোয়ানগরের বাসিন্দা রবিন্দ্র দাস। কয়েক প্রজন্ম ধরে রবিন্দ্র দাসের পরিবারের সদস্যরা বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা কালনী-কুশিয়ারা নদী আর উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কারণ ভরা বর্ষায় নদী, খাল, বিল ও হাওরে নতুন পানিতে টইটম্বুর থাকলেও মিলছে না সেই পরিমাণ মাছ। এতে নদীতে মাছ শিকার করতে যাওয়া রবিন্দ্র দাসের ৮ সদস্যের দলের রোজকার খরচই উঠছে না। আবার কোনোদিন গুনতে হচ্ছে লোকসানও। বিশেষ করে চলতি বর্ষা মৌসুমে নদী, হাওর-বাঁওড় ও খাল-বিলে মাছের সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে।
রবিন্দ্র দাস বলেন, পূর্বপুরুষের হাত ধরেই এ পেশায় আসা। কিন্তু কয়েক বছর মাছের যা আকাল তাতে তিনবেলা খাবার জোটাই এখন দায়। এখন পুরো বর্ষায় রাত ৩টা থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত নদীতে জাল ফেলেও ৫/৬ কেজি মাছ মিলে না। দুই নৌকায় আটজন সদস্যের মাথাপিছু রোজ ৩০০ টাকাও আয় করা যায় না। এ বছর নদীতে মাছ নেই বললেই চলে। আগামী দিনগুলো কীভাবে চলব জানি না। শুধু রবিন্দ্র দাসই নন হাওর, নদীতে মাছের এমন সংকটে দৈনন্দিন মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা স্থানীয় জেলেদের মধ্যে চরম হাহাকার দেখা দিয়েছে।
জেলেরা জানান, নদী, বিল হাওরে চায়না দুয়ারি জাল, কারেন্ট জালসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ জাল, ইলেক্ট্রিক শকে মাছ শিকার, শুকনো মৌসুমে উপজেলার ইজারাকৃত মৎস্য বিল, জলাশয় ও মাছের অভয়ারণ্যগুলো অবৈধভাবে শুকিয়ে ফেলা ও মাছের অভয়ারণ্য সংরক্ষণে স্থানীয় মৎস্য বিভাগের উদাসীনতার কারণে এক সময়ের মাছের ভাণ্ডারখ্যাত এ উপজেলায় দেশি মাছের এমন সংকট দেখা দিয়েছে।
তবে স্থানীয় মৎস্য বিভাগের দাবি, দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষেণ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে নিয়মিত কাজ করছেন তারা। এ ছাড়া নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪১ হাজার। জেলায় গত এক দশকে নদী, হাওর উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশি মাছের উৎপাদন কমেছে উদ্বেগজনক হারে। তবে বেড়েছে চাষের মাছের উৎপাদন।
নদীতে মাছ ধরতে আসা সুদাম দাস বলেন, বছর তিনেক আগেও এ মৌসুমে বেশ মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু এ বছর নদী ও হাওরে মাছ নেই বললেই চলে।জেলে মনোহর দাস জানান, বছরের প্রায় সময়ই নদী ও হাওরে কারেন্ট, চায়না দুয়ারীসহ নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছে শিকার হচ্ছে। আর এখন নতুন যোগ হয়েছে ইলেক্ট্রিক শক দিয়া মাছ শিকার করা। মৎস্য বিভাগের এ বিষয়ে কোনো তৎপরতা নাই বললেই চলে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষৎতে হয়তো নদীতে আর পোনা মাছও মিলবে না।
পৌর সদরের মাছের আড়তদার নানু মিয়া বলেন, আগে নদী, হাওর থেকে যে মাছ আসত এখন এর সিকি ভাগও আসছে না। এ বছর তো নদীর মাছ নাই বললেই চলে।কাজল মিয়া নামের আরেক আড়তদার জানান, বছর তিনেক আগেও আড়তগুলোতে যেখানে দিনে ৪০-৫০ মণ নদীর মাছ আসতো। এ বছর সারা দিনে ৮/১০ মণ মাছও আসে না।উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. সোহানুর রহমান বলেন, হাওরে বিভিন্ন দেশি প্রজাতির মাছগুলো প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠে। আমরা বিভিন্ন সময়ে জলাশয়ে মাছের পোনা অবমুক্ত করি। হাওরে দেশি মাছের মূল সংকটের কারণ হচ্ছে জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার, অবৈধ নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার এবং দেশি প্রজাতির মাছগুলো ছোট থাকতেই শিকার করা।
তিনি বলেন, আমাদের লোকবল সংকটের কারণে আমরা সবসময় মাঠে কাজ করতে পারি না। তবে বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করে নিষিদ্ধ জাল জব্দ ও ধ্বংস করছি। হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জলজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগের প্রভাষক ইফতেখার আহমেদ ফাগুন বলেন, মূলত জলবায়ু পরিবর্তন এবং ফসলি জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মাছের প্রজনন ক্ষমতা কমে গেছে। এ ছাড়া মাছের অভয়াশ্রম ও হাওর নষ্ট হয়েছে। অবৈধ পদ্ধতিতে মাছ নিধন করা হচ্ছে। এমনকি পানি শুকিয়ে মাটির নিচ থেকেও মাছ ধরা হচ্ছে ফলে দেশীয় মাছের আকাল তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, এখনো দেশীয় প্রজাতির এ মাছকে রক্ষা করা সম্ভব। এর জন্য মাছের অভয়ারণ্য তৈরি করতে হবে। হাওর এলাকায় বিজ্ঞানভিত্তিক উন্নয়ন করতে হবে। এছাড়া যেসব মাছ হারিয়ে গেছে, গবেষণার মাধ্যমে সেগুলোতে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রকল্প নিতে হবে।
এআই