দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশবাসীর সার্বিক সহযোগিতা এবং সহমর্মিতার লক্ষ্যে বাংলাদেশ পুলিশের অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেছে জেলা পুলিশের সদস্যরা।
বুধবার (৭ আগস্ট) দুপুর ১টায় বরিশাল জেলা পুলিশ লাইন্সে এ সংবাদ সম্মেলনে সাধারণ কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পদের পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এসময় লিখিত বক্তব্যে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে পুলিশ সদস্যরা বলেন, আপনাদের একটি নতুন বাংলাদেশে স্বাগতম। গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সেসকল শহিদদের যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত হয়েছেন। তাদের পরিবারের প্রতি আমরা সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। পাশাপাশি আন্দোলনে আহতদের আশু সুস্থতা কামনা করছি।
তারা বলেন, একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য হিসেবে এবং সরকারি আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থুবই ক্ষীণ। তথাপিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে শুরু থেকেই পুলিশের অধিকাংশ সদস্য মৌনভাবে একাত্মতা পোষণ করে এসেছে বলে আমরা দ্ব্যর্থ কণ্ঠে বলতে চাই। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীসহ প্রতিটি বাহিনী একটি চেইন অব কমান্ড অনুসরণ করে চলে। চেইন অব কমান্ড অনুসরণ করেই পুলিশ বাহিনীর অধস্তনরা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে মাত্র। আর সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই পুলিশ বাহিনী আজ ছাত্র-জনতার মুখোমুখি। এছাড়াও বরাবরই পুলিশের প্রতি কিছু সংখ্যক সাধারণ জনাতার একটা ক্ষোভ কাজ করে কিন্তু কেউ কখনো এটা ভাবে না আমরাও তাদের মতো কারো সন্তান, তাদের মতো কখনো ছাত্র ছিলাম, এখন চাকরির জন্য দায়িত্বের খাতিরে ঊর্ধ্বতনদের আদেশ মানতে আমরা বাধ্য, সেখানে আমাদের দোষটা কোথায়।
তারা দেশবাসীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এবং গত ৫ আগস্ট সরকারের পদত্যাগের পর থেকে একটি শ্রেণি কর্তৃক টার্গেট করে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে বিভিন্ন পুলিশ লাইনে, খানা, পুলিশ ফাড়ি, পুলিশ বক্স এবং যানবাহনে। আহত হয়েছে শত শত পুলিশ সদস্য। আমরা এসব ধ্বংসযজ্ঞের নিন্দা জানাই। আমরা বিশ্বাস করি মুক্তিকামী সাধারণ ছাত্র-জনতা কখনোই এসব ধ্বংসযজ্ঞের পক্ষে না। একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য হিসেবে আমরা সর্বদা জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার্থে আইন অনুযায়ী বদ্ধ পরিকর। গত ৫ আগস্ট সরকারের পদত্যাগের পর থেকেই আমরা দেখেছি, আমাদের অভিভাবকগণ কোনো ধরনের নির্দেশনা ছাড়াই আত্মগোপনে চলে যান যা আমাদেরকে নিরাপত্তাহীনতায় ফেলে দেয়। যথাযথ নির্দেশনার অভাবে আমরা অনেক পুলিশ সদস্যদের হারিয়েছি। বর্তমানে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি কর্তৃক পুলিশ সদস্যদের বাসাবাড়িতেও হামলা চালানো হচ্ছে। জীবন রক্ষার্থে অনেকে আত্মগোপনে আছে। এমতাবস্থায়, পুলিশ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যদের নিরাপত্তার দাবি নিশ্চিত না হওয়া অবধি আমরা পুলিশ বাহিনীর অধঃস্তনরা কর্মবিরতি ঘোষণা করছি।
দেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষত অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সার্বিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিম্নোক্ত দাবিসমূহ পেশ করা হলো-
পেশ করা ১১টি দাবি হলো-
১. চলমান ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশ হত্যাসহ সকল পুলিশি স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে অতিদ্রæত বিচারের আওতায় আনতে হবে।
২. নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারকে এককালীন আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান, আজীবন পেনশন-রেশন প্রাপ্তি এবং পরিবারের একজন সদস্যের সরকারি চাকরি নিশ্চিত করা। আহত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা এবং গুরুতর আহত পুলিশ সদস্যদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা।
৩. পুলিশের নিয়োগ বিধিমালা বিশেষত সাব-ইন্সপেক্টর এবং সার্জেন্ট নিয়োগ পিএসসির অধীনে এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টারের অধীনে কনস্টেবল নিয়োগে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
৪. সাব-ইন্সপেক্টর/সার্জেন্ট পদে বিদ্যমান পদোন্নতি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা। সেক্ষেত্রে পুলিশ পরিদর্শক পদ থেকে সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে ৩০ শতাংশ সরাসরি এবং ৭০ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ এবং সেটি যথাসময়ে নিশ্চিত করা। সাব-ইন্সপেক্টর/সার্জেন্ট থেকে ইন্সপেক্টর পদে পিএল হওয়ার ১ বছরের মধ্যে পদোন্নতি দিতে হবে। এছাড়া কনস্টেবল/নায়েক/এটিএসআই/এএসআই পদোন্নতির ক্ষেত্রে পরীক্ষায় পাশকৃতদের পরবর্তী বছর পুনঃপরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা বাতিল এবং পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে পাশকৃতদের সিনিয়রিটি অনুসরণ করা।
৫. আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, পুলিশের কর্মঘণ্টা কমিয়ে ৮ ঘণ্টা করা এবং অতিরিক্ত কর্মঘণ্টায় জন্য ওভারটাইম প্রদানের ব্যবস্থা করা অথবা বছরে ২টি বেসিকের সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করা।
৬. পুলিশের ঝুঁকি ভাতা বৃদ্ধিকরণ, টিএ/ডিএ বিল প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে প্রদান এবং প্রযোজ্য সকল সেক্টরে সোর্স মানী ফ্রেশ মানী নিশ্চিত করতে হবে।
৭. পুলিশ সদস্যদের বাৎসরিক ২০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি বৃদ্ধি করে অন্যান্য বাহিনীর সাথে সমন্বয় করে ৬০ দিন করতে হবে। দেশ এবং জনগণের স্বার্থে ছুটি ছাড়া সম্ভব না হলে অভোগকৃত ছুটির বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা প্রদান করতে হবে।
৮. পুলিশ বাহিনীর প্রচলিত পুলিশ আইন এবং পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল সংস্কার করে যুগোপযোগী এবং কার্যকরী করতে হবে যার মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর মর্যাদা এবং অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকার নিশ্চিত হয়।
৯. পুলিশ বাহিনীকে যেন কোনো দলীয় সরকার তার রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার করতে না পাবে সেজন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে।
১০. পুলিশের সকল থানা, ফাড়ি এবং ট্র্যাফিক বক্স আধুনিকায়ন করতে হবে এবং অধস্তন অফিসারদের জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
১১. নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের অধস্তন কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং সকল ব্যারাকে বিদ্যমান আবাসন সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে ব্যারাকগুলোকে আধুনিকায়ন করতে হবে।
প্রিয় দেশবাসী, একটি নিরপেক্ষ এবং যুগোপযোগী পুলিশ বাহিনী গড়ে উঠুক সেটি আপনাদেরও দাবি। আর সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন সংস্কার ও প্রণয়ন এবং উল্লিখিত দাবিসমূহ অনতিবিলম্বে বিবেচনায় নেবার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সেইসাথে দেশবাসী সকলের কাছে অনুরোধ করছি আপনারা পুলিশের প্রতি এই ক্ষোভ রেখে দয়া করে আমাদেরকে একটু বোঝার চেষ্টা করেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মিছিল করেন উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা।
এইচএ