সেদিন ছিল ২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল। গভীর রাতে রাজশাহী নগরীর হেতেমখাঁ এলাকার একটি বাড়ি থেকে ভেসে এসেছিল চিৎকার আর কান্নার শব্দ। স্থানীয়রা ভেবেছিলেন, হয়তো আবারও কোনো পারিবারিক কলহের ঘটনা। কিন্তু ভোর হতেই জানা গেল, এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের খবর—এক ভাই নিজ হাতে খুন করেছে নিজের আপন ভাই ও বোনকে। আর দীর্ঘ দশ বছর পর, সেই নারকীয় ঘটনার বিচার পেল পরিবার।
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) দুপুরে রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক আবুল কালাম আজাদ রায় ঘোষণায় বলেন, “এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য। তাই আদালত তরিকুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করছে।”
মামলার এজাহারে বলা হয়, পারিবারিক জমিজমা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল তরিকুল ইসলামের সঙ্গে তার ভাই সাদেকুল ইসলাম ও বোন আক্তারা জাহান কল্পনার। এই বিরোধ একসময় চরমে পৌঁছায়। ঘটনার রাতে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে তরিকুল তার ভাই সাদেকুলকে শাবল দিয়ে বুকে আঘাত করে হত্যা করে। বোন কল্পনা ঘটনাটি দেখে ফেলায় তাকেও একইভাবে হত্যা করে।
শুধু এতেই থেমে থাকেনি তরিকুলের নিষ্ঠুরতা। এরপর সে বাড়ির অন্যান্য ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা মেরে বন্ধ করে দেয় এবং সেখানে থাকা ভাবীসহ আরও চারজনকে আহত করে।
হেতেমখাঁর বাসিন্দা ৭৫ বছর বয়সী আমিনুল হক এখনো ভুলতে পারেন না সেই রাত। তিনি বলেন, “রাত তখন দুইটা কি সোয়া দুইটা বাজে। হঠাৎই ভেতর থেকে এক নারীর কান্না আর সাহায্যের আর্তি শুনি। আমরা কয়েকজন গিয়ে দেখি, ঘরের দরজা তালাবদ্ধ। ভেতর থেকে কেউ চিৎকার করছে। পুলিশে খবর দেই। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে যা দেখে, তাতে গা শিউরে ওঠে।”
পুলিশ সেদিন রাতেই তরিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করে এবং বোয়ালিয়া মডেল থানায় মামলা করা হয় নিহত সাদেকুলের ছেলে ইউসুফ আলি সিজারের পক্ষ থেকে।
দীর্ঘ দশ বছরের তদন্ত ও শুনানির পর অবশেষে মঙ্গলবার মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। মামলায় ১৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। উপস্থাপন করা হয় ফরেনসিক রিপোর্ট, আলামত, এবং ঘটনার সময়কার প্রতিবেশীদের বয়ান।
বাদীপক্ষের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মোহাম্মদ শামীম আহমেদ বলেন, “আমরা আদালতে প্রমাণ করতে পেরেছি যে এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এমন নিষ্ঠুর ও নির্মম ঘটনা সমাজে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি রাখে। আদালতের এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।”
আসামীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাহমুদুর রহমান রুমন রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমার মক্কেল ন্যায়বিচার পাননি। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো। কিছু সাক্ষ্য ও আলামতের মূল্যায়নে ঘাটতি আছে বলে আমরা মনে করি।”
রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন আসামী তরিকুল ইসলাম। মুখে কোনো অনুশোচনার ছাপ ছিল না বলেও জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
ঘটনার দশ বছর পেরিয়ে গেলেও নিহতদের পরিবার আজও সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। সাদেকুলের ছেলে ইউসুফ আলি সিজার বলেন, “আমার বাবাকে ও খালাকে ঘুমন্ত অবস্থায় নির্মমভাবে খুন করেছে আমার চাচা। শাস্তি পেতে এত বছর লাগলো। তবে এখন অন্তত শান্তি পাচ্ছি এই ভেবে যে বিচারটা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা মামলা চালিয়ে গেছি অনেক কষ্টে। অনেক সময় টাকার অভাবে মামলার কাজ থমকে গিয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম, সত্যের জয় একদিন হবেই।”
স্থানীয় সমাজকর্মী রেহেনা মনে করেন, এই রায় সমাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। “জমিজমা, সম্পত্তি নিয়ে এখনো আমাদের সমাজে অসংখ্য মামলা, বিরোধ চলছে। পরিবারে যদি সহনশীলতা না থাকে, তাহলে এমন মর্মান্তিক পরিণতি ঘটতেই পারে। এই রায় মানুষকে ভাবতে শেখাবে—সম্পদ নয়, সম্পর্ক বড়।”
নাম প্রকাশে রাজশাহী জেলা বারের সিনিয়র আইনজীবী বলেন, “এই রায়ে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে যেভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, তা আইনি প্রক্রিয়ার একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। পাশাপাশি মামলাটি দীর্ঘ সময় ধরে চললেও অবশেষে যে ন্যায়বিচার পাওয়া গেছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।”
এই ঘটনা শুধুই একটি পারিবারিক হত্যাকাণ্ড নয়। এটি এক প্রজন্মের জন্য সতর্কবার্তা—পরিবারে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কিভাবে চরম পরিণতির দিকে যেতে পারে। জমি কিংবা সম্পত্তির জন্য যখন ভালোবাসা, রক্তের সম্পর্ক ভুলে যায় মানুষ, তখন এমন মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ঘটে।
একইসাথে, এই রায় আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা হয়তো ধীরগতির, তবে নির্ভুল নয়। ন্যায়বিচার হয়তো দেরিতে আসে, কিন্তু একদিন ঠিকই আসে।
এনআই