দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র সাতকানিয়া উপজেলার কেরানীহাট। প্রতিদিন ভোর থেকেই জমতে শুরু করে বাজারের চারপাশ। সবজি, চাল, ডাল, মাছের গাড়ি আসে একের পর এক। হাজার হাজার মানুষের হাঁটাচলা। কিন্তু এই ব্যস্ততার মধ্যে একটি বড় অভাব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে — এত গুরুত্বপূর্ণ বাজার ও ট্রাফিক পয়েন্টে নেই কোনো নির্ধারিত বাস টার্মিনাল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অথবা সড়কের ওপর ঝুঁকি নিয়ে বাস-সিএনজিতে ওঠানামা করতে হয় যাত্রীদের। এতে তৈরি হয় তীব্র যানজট। পথচারীদের হাঁটাচলা কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, নেই যাত্রীদের জন্য কোনো পাবলিক টয়লেট বা বিশ্রামাগার। জরুরি প্রয়োজন হলে ছোটাছুটি করতে হয় হোটেল-মসজিদ কিংবা দোকানে।
কেরানীহাটের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এখান থেকে বান্দরবান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম — সব জায়গায় সরাসরি সড়ক সংযোগ রয়েছে। একটি আধুনিক টার্মিনাল নির্মাণ করা গেলে এটি চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে। বাজারের ভেতরে পাবলিক টয়লেট, বিশ্রামাগার, ফুডকোর্ট নির্মাণ করা হলে ক্রেতারা এখানে আসতে আগ্রহী হবেন।
শনিবার (২৬ এপ্রিল) রাত ১০টায় কেরানীহাট মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখা গেল, সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি বড় বাস ও মিনিবাস। বাস থেকে নেমে আসা যাত্রীরা ব্যাটারিচালিত রিকশা কিংবা সিএনজি অটোরিকশা করে যার যার গন্তব্যে যাচ্ছেন। কিন্তু বাসগুলোর এলোমেলো দাঁড়ানোয় পুরো রাস্তা প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
কেরানীহাট বাজারের আশপাশের প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকার মানুষজন এখানে কেনাকাটার জন্য আসেন। বান্দরবান, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ থেকেও অনেকে এখানে আসেন। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট বাসস্ট্যান্ড বা টার্মিনাল না থাকায় প্রতিদিন ছোট-বড় দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। পথচারীরা বলেন, হঠাৎ গাড়ির গতি বেড়ে গেলে বা বাসের চাকা পিছলে গেলে বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা ঝুঁকির মধ্যে পড়েন।
কেরানীহাট বাজারে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করলে টের পাওয়া যায়, এখানকার সবচেয়ে বড় সংকট — পাবলিক টয়লেটের অভাব। বিশাল বাজারের ভেতর বা আশপাশে কোনো পাবলিক টয়লেট নেই। ফলে জরুরি প্রয়োজনে মানুষকে দোকানদারদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে শৌচাগার ব্যবহার করতে হয়। অনেকে নিরুপায় হয়ে রাস্তার পাশে বা ঝোপঝাড়ে যেতে বাধ্য হন। বিশেষ করে নারীদের জন্য এটি চরম লজ্জাজনক ও দুর্ভোগের।
কলেজছাত্রী রুবিনা আক্তার বলেন, “অনেকবার ভোগান্তিতে পড়েছি। বাস থেকে নেমে টয়লেট খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। কোথাও সুযোগ নেই। এটা কি সভ্যতার পরিচয়?”
স্থানীয় বৃদ্ধ রফিক মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, “আশার কথা অনেক শুনছি। এখন চাই কাজের কথা। একটা টার্মিনাল দেন, টয়লেট দেন — আমাদের জীবনটাও তো জীবন।”
কেরানীহাট বাজার দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম পুরোনো হাট। শতবর্ষী এই বাজারের ঐতিহ্য রয়েছে। কৃষিপণ্য, মাছ, ফলমূল, পোশাক, ইলেকট্রনিক্সসহ প্রায় সবকিছুই এখানে কেনাবেচা হয়। প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ আসেন এখানে। ঈদ-পূজা কিংবা অন্য উৎসবের মৌসুমে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫০ হাজারে।
কিন্তু বাজারের অবকাঠামো সেই তুলনায় নাজুক। রাস্তা সংকীর্ণ, ড্রেন খোলা, চারপাশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, বিশ্রামের জন্য কোনো ছায়াময় জায়গা নেই। ফলে ভোগান্তির কারণে অনেক ক্রেতা এখন বিকল্প বাজারের দিকে ঝুঁকছেন। এতে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
বাজারের মুদি ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন বলেন, “অনেক ক্রেতা বলতেছে, যানজটের ঝামেলা সহ্য হয় না, টয়লেটেরও জায়গা নাই — তাই আর আসবে না। এইভাবে ব্যবসা কমে যাচ্ছে।”
কেরানীহাট প্রগতিশীল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনজুর আলম জানান, “প্রশাসনের উদ্যোগ শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন সময় স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা কেরানীহাটের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কখনো টার্মিনাল নির্মাণ, কখনো পাবলিক টয়লেট স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ শুরু হয়নি।”
সাতকানিয়া উপজেলা প্রশাসন কয়েক বছর ধরেই বলছে, বাস টার্মিনাল ও পাবলিক টয়লেট নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কখনো বাজেট না মেলায়, কখনো জায়গা সংকটে কাজ এগোয়নি।
জানতে চাইলে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস বলেন, “কেরানীহাটে নাগরিক সুবিধার জন্য একটি বাস টার্মিনাল ও পাবলিক টয়লেট নির্মাণের কাজ দ্রুততম সময়ে শুরু হবে।”
এনআই