আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে প্লাস্টিকের বহু উৎস। রান্নার পাত্র, পানির বোতল, চা-কফির কাপ, পণ্যের মোড়ক—কোথায় নেই প্লাস্টিক? এগুলো থেকে প্রতিনিয়ত আমাদের খাবারে মিশে যাচ্ছে প্লাস্টিক।
গবেষকদের অনুমান, একজন আমেরিকান বছরে প্রায় ৩৯ হাজার থেকে ৫২ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গ্রহণ করে। এই কণাগুলো পানীয় জল, খাবার এবং খাবার তৈরির সরঞ্জাম—সবকিছু থেকেই আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। যদিও আরও গবেষণার প্রয়োজন, প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী এই কণাগুলো কোষের ক্ষতি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এবং নির্দিষ্ট ধরনের ক্যানসারের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে।
রান্নাঘরে অদৃশ্য বিপদ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রান্নাঘরের কয়েকটি সাধারণ জিনিস মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণের প্রধান উৎস:
প্লাস্টিক ফুড স্টোরেজ কন্টেইনার: গত সেপ্টেম্বরের একটি গবেষণা অনুযায়ী, খাদ্য প্যাকেজিং-এ ব্যবহৃত ১৪ হাজার পরিচিত রাসায়নিকের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ অর্থাৎ (৩ হাজার ৬০৭টি) মানুষের শরীরে শনাক্ত হয়েছে।
২০২৩ সালের জুনে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিকের পাত্র মাইক্রোওয়েভে গরম করলে খাদ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ন্যানোপ্লাস্টিকের সর্বোচ্চ নিঃসরণ ঘটে। ন্যানোপ্লাস্টিকগুলো ১ মাইক্রনের চেয়ে ছোট হওয়ায় তা আরও বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। এমনকি ফ্রিজে রাখা বা সাধারণ তাপমাত্রায় রাখলেও ছয় মাসে কোটি কোটি কণা নিঃসৃত হতে পারে।
বিপিএ-মুক্ত (BPA-free) পাত্রও নিরাপদ নয়। দাবি করা হয়, এই ধরনের পাত্রে শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত রাসায়নিক বাইস্ফেনল-এ থাকে না। এ ধরনের পাত্র সাধারণ প্লাস্টিকের চেয়ে কিছুটা ভালো, তবুও ওভেনে কাচের পাত্র বা সিলিকন ব্যবহার করাই সবচেয়ে নিরাপদ বিকল্প। কাচের পাত্র ওভেনে, ফ্রিজে বা মাইক্রোওয়েভে ব্যবহার করা নিরাপদ।
রান্নাঘরে বাসনপত্র: কাটাকুটির জন্য এখন ঘরে ঘরেই ব্যবহার হয়ে থাকে প্লাস্টিকের চপিং বোর্ড। এর প্রতিটি স্লাইসে বের হতে পারে আনুমানিক ১০০ থেকে ৩০০টি মাইক্রোপ্লাস্টিক। ২০২২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি গবেষণায় সুপার মার্কেটে প্লাস্টিকের চপিং বোর্ডে কাটা মাংসের ভেতর মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়। গবেষকেরা জানান, তিন মিনিট ধরে ভালোভাবে ধোয়ার পর মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ কমলেও মাংস থেকে তা পুরোপুরি দূর হয়নি।
দাগ বা আঁচড় পড়া নন-স্টিক রান্নার পাত্র থেকে প্রতিবার ব্যবহারে হাজার থেকে লাখ লাখ প্লাস্টিকের কণা নির্গত হয়। প্লাস্টিকের ব্লেন্ডারে তীব্র ঘর্ষণে তৈরি হয় অসংখ্য মাইক্রোপ্লাস্টিক। প্লাস্টিকের পাত্রের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে অনেকে সিলিকন সুপারিশ করলেও এটা থেকে কম মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপন্ন হয়, এমন কোনো প্রমাণ নেই। বরং এ ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের পাত্রের বদলে কাচ বা স্টেইনলেস স্টিলের পাত্রে খাবার সংরক্ষণ করা হলে তা প্লাস্টিকের মাত্রা কমিয়ে আনতে পারে।
পানি: ট্যাপ থেকে হোক বা বোতল, মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন হলো পানি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিকের বোতলে প্রতিবার খোলা–বন্ধের ঘটনায় প্রতি লিটার পানিতে প্রায় ৫৫৩টি মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হয়। যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণায় ১৭৭টি ট্যাপের পানির নমুনার প্রতিটিতেই প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। চীন, ইউরোপ, জাপান, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রে অনুসন্ধানের ফলাফলও একই রকম। বলতে গেলে মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে পানির ফিল্টার ব্যবহার একটি সমাধান হতে পারে। ভালো ফিল্টার ও পানির পাত্র কমাতে পারে প্লাস্টিক গ্রহণের মাত্রা।
টি-ব্যাগ: ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি পর্যালোচনা দেখায়, টি-ব্যাগ গরম চায়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা যোগ করার অন্যতম প্রধান উৎস। একটি টি-ব্যাগ থেকে ১০০ কোটিরও বেশি কণা নিঃসৃত হতে পারে। এমনকি ‘কম্পোস্টেবল’ লেবেল দেওয়া টি-ব্যাগও অনেক সময় উদ্ভিজ্জ উপাদানের আড়ালে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হতে পারে।
এ কারণে গরম পানীয়ের জন্য খোলা চা পাতা এবং স্টেইনলেস স্টিলের টি-ইনফিউজার ব্যবহার করা সবচেয়ে ভালো। পানি গরম করার জন্য কাচের বৈদ্যুতিক কেটলি ব্যবহার করাও নিরাপদ।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, তবে ধীরে ধীরে রান্নাঘর থেকে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলার অভ্যাস করাই বুদ্ধিমানের কাজ। যে প্লাস্টিক সামগ্রীগুলো ঘন ঘন গরম করা হয়, ফ্রিজে রাখা হয় বা ডিশওয়াশারে ধোয়া হয়, সেগুলোর পরিবর্তে সিলিকন, কাঠ, ধাতু বা কাচের জিনিস ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
এইচএ