গত ১৬ বছরে যশোরের বেনাপোল বন্দরের গুদামে ১২ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা কোন ক্ষতিপূরণ পাননি। ঢাকার বিমান বন্দর কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার পর বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিকল্পিত নাশকতা যাতে না ঘটে সেজন্য বন্দর ও পুলিশ প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছেন, ঢাকায় আগুন লাগার পর তারা আরও বেশি সতর্ক হয়েছেন। কড়া নজরদারি করার পাশাপাশি নেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ইতোমধ্যে বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) থেকে পরিচয়পত্র ছাড়া বন্দরে প্রবেশ বন্ধ করতে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। বন্দরের মধ্যে ধুমপান, আগুনের ব্যবহার নিষিদ্ধ ও ফায়ার সিস্টেম সচল রাখতে নিয়মিত পরীক্ষা করা হচ্ছে। বেনাপোল ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলে এসেছে। তাদের পর্যবেক্ষণ হলো- বেনাপোল বন্দরে অগ্নি নিরাপত্তা যথেষ্ট নেই।
জানা গেছে, দেশের বৃহত্তর স্থলবন্দর বেনাপোলের অধিকাংশ গুদাম এবং ওপেন ইয়ার্ডে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অর্পযাপ্ত। যে কারণে পণ্যাগার অগ্নিকান্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে।
এ ছাড়া, বন্দরের ফায়ার স্টেশনে জনবল কম থাকায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত তারা আগুন নেভাতে পারেন না। জনবল বাড়ানো দরকার। বন্দরে জায়গা সংকটের কারণে আমদানি করা অতি দাহ্য পণ্যের পাশাপাশি সাধারণ পণ্য রাখা হচ্ছে। এতে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি বাড়ছে।
সর্বশেষ গত ২০২২ সালের ২৬ আগস্ট বন্দরের ৩৫ নম্বর শেডে আগুনে কোটি টাকার আমদানি করা পণ্য পুড়ে যায়। এ জন্য অগ্নিকান্ডের ঝুঁকির কথা জানিয়েছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ২০ লাখ ১১ হাজার ২৬৮ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে। একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৪ লাখ ২১ হাজার ৭১৩ মেট্রিক টন পণ্য।
বাণিজ্য সংশিষ্টরা জানান, প্রতি বছর বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার আমদানি ও ৮ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি বাণিজ্য হয়। সব সময় বন্দরটিতে প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন পণ্য মজুদ থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় এ পথে সবচেয়ে যেমন বেশি বাণিজ্য হয়, তেমনি অগ্নিকান্ডের ঘটনাও বেশি ঘটে বন্দরটিতে।
প্রতি বছরেই কখনও পণ্যগার, কখনও পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন লাগতে দেখা যায়। গত ১৬ বছরে বেনাপোল বন্দরে বড় ধরনের ১২টি অগ্নিকান্ডের ঘটনায় আমদানি পণ্য পুড়ে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয় ব্যবসায়ীদের।
বন্দরের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বারবার। তবে, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় আগুনের ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে বন্দর কর্তৃপক্ষকে। এতে জোরদার করা হয়েছে সুরক্ষা ব্যবস্থা। বন্দর ব্যবহারকারী বাণিজ্যিক সংগঠন ও কাস্টমসের সঙ্গে বৈঠক করে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অগ্নিনির্বাপণকর্মীদের সচেতন থাকতে বলা হয়েছে। বন্দরে প্রবেশকারীদের সঙ্গে থাকা ব্যাগ তল্লাশি করে বন্দর অভ্যন্তরে অনুমতি মিলছে।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, গত ১৬ বছরে বন্দরের গুদামে ১২ বার আগুন লেগেছে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় প্রতিবারই আগুন নেভাতে ব্যর্থ হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। দমকল বাহিনী ডেকে আগুন নেভাতে হয়। এর আগেই পুড়ে যাচ্ছে আমদানি করা কোটি কোটি টাকার পণ্য। আগুনে পণ্য পুড়লেও ক্ষতিপূরণ পাননি আমদানিকারকরা। ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, কিন্তুু সে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয় না কখনই।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বেনাপোল বন্দরে ৩৮টি গুদাম ও ওপেন ইয়ার্ড রয়েছে। এখানে ধারণক্ষমতা ৪৭ হাজার ৪৪০ টন পণ্য। কিন্তু রাখা হচ্ছে প্রায় দেড় লাখ টন পণ্য। গাদাগাদি করে পণ্য রাখার কারণে অগ্নিঝুঁকি আরো প্রকট হয়েছে।
জানা যায়, বন্দরের পণ্যগারে দীর্ঘদিন ধরে মেয়াদোউত্তীর্ণ নিলামযোগ্য পণ্যের পরিমাণ ১২ হাজার ৬৫৯ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৩ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ বিপদজনক রাসয়নিক দ্রব্য। এসব রাসায়নিক পণ্য অগ্নিকান্ডর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
সম্প্রতি বন্দরের বিভিন্ন গুদামে গিয়ে দেখা গেছে, অতি দাহ্য ও সাধারণ পণ্য কাছাকাছি রাখা রয়েছে। ড্রামভর্তি ডাইস (রঙ), বস্তা ভরা রেইজিং পাউডার, ছাপাখানার কালিসহ অন্যান্য পণ্য রাখা আছে।
গুদামের সাথে রয়েছে বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (এক্সটিংগুইসার)। পাশের ৩৪ নম্বর গুদামে গিয়ে দেখা যায়, মটরগাড়ির ইঞ্জিন তেলসহ (লুব্রিকেন্ট) বিভিন্ন ধরনের পণ্য রয়েছে। এখানেও পণ্য রাখার কোনো শৃঙ্খলা নেই। ওইগুলো দেখলেই বোঝা যায়, বহুকাল যন্ত্রগুলোতে হাত দেওয়া হয়নি। ২৯ নম্বর গুদাম ও খালি ট্রাক টার্মিনালে গিয়েও একই চিত্র দেখা গেছে। আগুন নেভানো নিজস্ব ভালো কোনো ব্যবস্থাপনা নেই।
বন্দর ব্যবহারকারীদের সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে বন্দরের ১০ নম্বরসহ ১০টি পণ্যাগারে আগুনে পুড়ে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়, ২০০১ সালে ২৬ নম্বর পণ্যাগারে অগ্নিকান্ডে ক্ষতি হয় ৩০ কোটি টাকার পণ্য, ২০০৫ সালে ১০ ও ৩৫ নম্বর পণ্যাগারে আগুনের ঘটনায় ক্ষতি হয় ৭০ কোটি টাকার পণ্য, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারিতে ৩৫ নম্বর পণ্যাগারে আগুনে ক্ষতি হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার পণ্য, একই বছরের ২২ জুন ২৭ নম্বর পণ্যাগারে আগুনে ক্ষতি হয় ১৫০ কোটি টাকার পণ্য, ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর বন্দরের ২৩ নম্বর গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটে। এতে গুদামে রাখা তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পের আমদানি করা কাপড়, ডাইস (রঙ), বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, শিল্পের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, মটরগাড়ির যন্ত্রাংশ, ফাইবার, মশা তাড়ানো স্প্রে, তুলা, কাগজসহ আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের পণ্য পুড়ে যায়।
২০১৮ সালের ৬ জুন বন্দরের ২৫ নম্বর শেডে আগুন ধরে এক ট্রাক পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভারতীয় ট্রাক টার্মিনালে এ ঘটনায় প্রায় ১০ কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যায়। ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট বন্দরের ৩৫ নম্বর শেডে অগ্নিকান্ডে প্রায় ৫০ কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যায় এবং ২০২২ সালের ৭ জুন বেনাপোল বন্দরের ৩৫ নম্বর পণ্যাগারের সামনে মহাসড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয় ব্লিচিং পাউডারবাহী ট্রাকে আগুন লেগে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয় ব্যবসায়ীদের। এসব অগ্নিকান্ডে তদন্ত কমিটি করা হলেও ব্যবসায়ীরা আজোও কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি।
এ ব্যাপারে বেনাপোলে বন্দর ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, ‘গত ১৬ বছরে বন্দরে অন্তত ১২বার আগুন লেগেছে। এতে শত শত কোটি টাকার পণ্য পুড়ে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। প্রায় বন্দরের গুদাম থেকে পণ্য চুরি হচ্ছে। বন্দরের প্রতিটি গুদাম ও ওপেন ইয়ার্ড অগ্নিকান্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে। এজন্য নজরদারি বাড়ানোর সাথে অগ্নি নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। কেননা দেশ বিরোধীরা নাশকতা ঘাটাবেনা এমন আশংকা উড়িয়ে দেয়া যাবেন।’
বেনাপোল ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়াডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, ‘বন্দরে পণ্য রাখার জায়গা বাড়াতে হবে। অতি দাহ্য পণ্যে নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। আগুন নেভানোর জন্য নিজস্ব ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাহলে কেবল এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। বন্দরের পণ্যগারে দীর্ঘদিন ধরে মেয়াদোউত্তীর্ণ নিলামযোগ্য পণ্যের দ্রুত অপসারণ করা দরকার। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ বিপদজনক রাসয়নিক দ্রব্যও রয়েছে। এসব রাসায়নিক পণ্য অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এই বন্দরটি অগ্নিঝুঁকিতে থাকছে সব সময়।’
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও আমদানিকারক মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘এর আগে কয়েকবার আগুন ধরে ব্যবসায়ীরা সর্বস্বান্ত হয়েছে। আমরা বারবার বলার পরও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ব্যবসায়ীরা সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছে, বন্দরের ভাড়া প্রদান করছে অথচ তাদের আমদানি করা পণ্যের নিরাপত্তা দিচ্ছে না। রহস্যজনক কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ এসব পণ্যের বীমাও করেন না। বেনাপোল বন্দর অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এজন্য কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে হবে। পুরো বন্দর সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে হবে।’
বেনাপোল ফায়ার সার্ভিসের ইনচার্জ বায়োজিদ বোস্তামি বলেন, ‘গত ৩০ সেপ্টেম্বর আমরা বেনাপোল বন্দরের গুদামগুলো পরিদর্শন করেছি। ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫ ও ৩৮ নম্বর শেডে কেমিক্যাল রাখা হয়। সেখানে ওই সময় ২৬ লাখ ৭১ হাজার ৬৫১ কেজি কেমিকেল পণ্য ছিল। চাহিদা অনুযায়ী সব সময় একই ওজনের কেমিক্যাল পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। বন্দরের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল। আমরা দাহ্য পদার্থ কিভাবে রাখতে হয় তার সঠিক দিকনির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহনের সুপারিশ করেছি। অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনা এড়াতে ফায়ার সিস্টেম নিয়মিত পরীক্ষা করা হচ্ছে। ৯০ একর জায়গায় স্থাপিত বেনাপোল বন্দরে অগ্নিকান্ড প্রতিরোধে ২টি ফায়ার স্টেশনে মাত্র ৭ জন জনবল রয়েছে। এটা বাড়ানো হলে আরও বেশি নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব।’
বেনাপোল বন্দরের ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান জানান, এত বড় স্থলবন্দরে মাত্র ছয়জন জনবল নিয়ে তাকে কাজ করতে হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনা ঘটলে আগুন নেভাতে বিলম্ব হয়। বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানালেও এখন পর্যন্ত জনবল নিয়োগ হয়নি।
এ ব্যাপারে বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক শামিম হোসেন রেজা বলেন, ‘অগ্নিঝুঁকি নেই এই কথা বলবোনা। তবে কেউ যদি নাশকতা করার চেষ্টা না করতে পারে সেজন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা বা নাশকতা রোধে পোশাকধারী নিরাপত্তাকর্মীদের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও রয়েছে নজরদারি। বন্দর সচল রাখার সঙ্গে আগুন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে হাই এলার্ট জারি করেছি। প্রতিটি গুদামে ফায়ার হাইডেন পয়েন্ট ও ফায়ার পাম্প রয়েছে। এ ছাড়াও, বন্দরে পড়ে থাকা নিলাম ও ধ্বংসযোগ্য ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য কাস্টমসকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরাতে বা ধ্বংস করতে অনুরোধ করা হয়েছে ‘ বন্দরের মধ্যে আগুন ব্যবহার ও কার্ডধারী ছাড়া প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
ইখা