চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া ইউনিয়নে পাহাড় কেটে অবৈধ মাটি বিক্রির ভয়াবহ ও সংগঠিত অপরাধ চক্রের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক পরিচয়, প্রশাসনিক নীরবতা এবং আর্থিক প্রভাবের সমন্বয়ে দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় ধ্বংস করে বাণিজ্যিক লাভের এই আয়োজন এখন প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্য, এই এলাকায় এখন যেন আইন নয়, কথা বলে ক্ষমতা ও প্রভাব।
সরেজমিনে দক্ষিণ চাকফিরানী দূর্লভের পাড়ার বিশাল পাহাড়ে গিয়ে দেখা যায়, চারদিক টিন দিয়ে ঘেরা, যেন ইচ্ছাকৃতভাবে অপরাধ কর্মকাণ্ড জনচক্ষুর আড়ালে রাখা হয়েছে। কখনো সবুজে আচ্ছাদিত সেই পাহাড়ের প্রায় অর্ধেক অংশ স্কেভেটরের আঘাতে মাটির সাথে মিশে গেছে। প্রায় ২৫ ফুট উচ্চতার এবং আনুমানিক ২০০ ফুট দীর্ঘ পাহাড়ের যে অংশটি কাটা হয়েছে, সেখানে এখন অসংখ্য শিকড়, কাটা গাছের গুঁড়ি ও বুলডোজারের অবশিষ্ট চিহ্ন পড়ে আছে। স্থানীয়দের দাবি, গত দেড় সপ্তাহ ধরে নিয়মিতভাবে রাতের আঁধারে এই কর্মকাণ্ড চলছে।
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, প্রতিদিন গভীর রাতে ৪ থেকে ৫টি ডাম্পার ট্রাকে বোঝাই করে এসব মাটি বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে। এলাকার বাজারদরে প্রতিটি গাড়ির মাটি বিক্রি হয় ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায়। ফলে প্রতিদিন লাখ টাকা সমপরিমাণ অর্থ পাচ্ছে সংশ্লিষ্ট চক্র। অথচ এই অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় কেউ সাহস পাচ্ছেন না। স্থানীয়দের অভিযোগ, অভিযুক্তরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ কিছু বললেও তা পরের দিনই হুমকি হয়ে ফিরে আসে।
ধ্বংস হওয়া পাহাড়টি স্থানীয় তিন ব্যক্তি, নুরুল কবিরের ছেলে জাফর ও মনজুর, এবং আলী আহমদের ছেলে শামসুল ইসলামের মালিকানাধীন বলে জানা গেছে। তবে মালিকানা নিয়ে থাকলেও কাজ পরিচালনা করছে দুই প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। সরেজমিন অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পাহাড় কাটার নেতৃত্বে রয়েছেন স্থানীয় বিএনপি নেতা হেলাল উদ্দীন এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ আবু রেজা মুহাম্মদ নদভীর ঘনিষ্ঠজন ও বর্তমান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর মোহাম্মদ আইয়ুব। রাজনৈতিক ভিন্ন পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তারা মিলে তৈরি করেছেন পাহাড় কাটার একটি অঘোষিত যৌথ সিন্ডিকেট।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা হেলাল উদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সময়ের কন্ঠস্বর-কে পাহাড় কাটার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, তিনি পাহাড়ের পশ্চিমাংশ কাটছেন এবং পূর্বাংশ কাটছে কাউন্সিলর আইয়ুব। তবে তিনি দাবি করেন, মালিকদের অনুমতি নিয়েই কাজ করা হচ্ছে। অপরদিকে কাউন্সিলর আইয়ুবের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে স্বীকার করে বলেন, “অনেক পাহাড় কেটেছি, কিন্তু কোনটা নিয়ে কথা বলছেন সেটা খোঁজ নিয়ে বলতে হবে।” এরপর তিনি ফোন কেটে দেন এবং পুনরায় যোগাযোগের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
পাহাড় কাটার এমন ঘটনার পরও পরিবেশ অধিদপ্তর এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের পরিদর্শক মইনুদ্দীন ফয়সালকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া মেলেনি। এতে স্থানীয়দের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, এত বড় অপরাধ কর্মকাণ্ড চললেও সংশ্লিষ্ট সংস্থা, বিশেষ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোহাগাড়ার দায়িত্বশীলরা নীরব কেন?
এ বিষয়ে লোহাগাড়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মং এছেন সময়ের কন্ঠস্বর-কে বলেন, পাহাড় ধ্বংস, পরিবেশ বিনষ্ট এবং অবৈধ মাটি বাণিজ্যের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অবস্থান শূন্য সহনশীলতা। তিনি সরেজমিন পরিদর্শনের কথা জানিয়ে বলেন, প্রভাবশালী যেই হোক, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিবেশবিদদের মতে, পাহাড় কাটার ফলে ভূমিধস, জলধারার পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ পানিস্তর কমে যাওয়া, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ে ভূমিধসের বহু দুঃখজনক ইতিহাস রয়েছে, যা এখনও স্মরণে থাকলেও অবৈধ সিন্ডিকেট থামছে না।
স্থানীয়দের দাবি, রাজনৈতিক পরিচয়, আর্থিক স্বার্থ ও প্রশাসনিক নীরবতার সমন্বয় পাহাড় ধ্বংসের মতো পরিবেশ অপরাধকে আরো বেপরোয়া করে তুলছে। যারা মতভেদে রাজপথে প্রতিপক্ষ, তারাই এখন পাহাড় কাটার বাণিজ্যে সহযোগী।
এসআর