আজ ৯ ডিস্মেবর, নেত্রকোনা ও পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস আজ। ৭১ সালের এই দিনে দেশের অন্য সব অঞ্চলের মতো মুক্ত হয় এই দুটি অঞ্চলও।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ভুঁইয়ার নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর দখলমুক্ত হয় দেবীগঞ্জ উপজেলা।
মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শুরুতেই মুক্তিযোদ্ধারা দেবীগঞ্জ সদরের তিন দিক অর্থাৎ করতোয়া নদীর পশ্চিম পাড়, ভাজনী এবং গোপাল বৈরাগী ঘাট এলাকায় পাকবাহিনীকে ঘেরাও করে রাখেন। দীর্ঘ সাত মাসের সংগ্রামের পর ৯ ডিসেম্বর ভোর ৬টা থেকে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হলে দখলদার বাহিনী পিছু হটে ডোমার হয়ে সৈয়দপুরের দিকে সরে যায়।
ওইদিন বিকাল ৪টায় দেবীগঞ্জ আনসার ক্লাবের সামনে ৩১ বার তোপধ্বনি ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দেবীগঞ্জকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিউল আলম প্রধান।
দেবীগঞ্জের যুদ্ধকালীন কোম্পানি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ভুঁইয়া সেই দিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমরা প্রায় ২৫-৩০ বছর ধরে দেবীগঞ্জ মুক্ত দিবস পালন করে আসছি। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর বিকেলে শফিউল আলম প্রধানসহ আমরা একত্রিত হয়ে দেবীগঞ্জকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করি। এরপর ১২ ডিসেম্বর দেবীগঞ্জ সার্কেল অফিসে পিস কমিটির লুটেরে জব্দ করা হয় ১০ কেজি রূপা, ৯২ ভরি স্বর্ণ ও ৯৬ হাজার টাকা। পরে সেই সম্পদ ব্যয় করা হয় দেবীগঞ্জ সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠায়।’
এদিকে, আজ ৯ ডিসেম্বর নেত্রকোনা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিবাহিনীর তিন দিক থেকে আক্রমণে পরাস্ত হয়ে ময়মনসিংহের দিকে পালিয়ে যায় পাক-হানাদার বাহিনী। গৌরব, ত্যাগ আর বিজয়ের এই দিনটি নতুন প্রজন্মের সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার অঙ্গীকারেই প্রতিবছর পালিত হয় নেত্রকোনা মুক্ত দিবস।
যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী আহমেদ জানান, মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত নেত্রকোনা জেলায় ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল হানাদাররা নেত্রকোনায় ঢুকে পড়ে। রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে তারা মেতে উঠে নির্যাতন আর হত্যাযজ্ঞে। মানুষকে ধরে এনে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে ফেলে দেয় নেত্রকোনার মোক্তারপাড়া ব্রিজ ও থানার পাশে মগড়া নদীর পাড়ে, চন্দ্রনাথ স্কুলের নদীর পাড়, চল্লিশা রেল ব্রিজে। পড়ে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলে একে একে বিভিন্ন অঞ্চলকে স্বাধীন করতে থাকে।
ঠিক একইভাবে ৮ ডিসেম্বর রাতে পূর্ব পরিকল্পনায় মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে নেত্রকোনা শহরকে ঘিরে ফেলে। একসাথে রাজুরবাজার, চকপাড়া, সাতপাই, কাটলী, নাগড়া জুড়ে রাতভর যুদ্ধ চলে। এইদিকে রাতে বিএডিসি ফার্ম সংলগ্ন রাস্তার পাশে থাকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চেক পোস্টের সৈনিকদের প্রতিহত করতে বর্তমান কৃষিফার্ম এলাকায় এম্বুশ পেতে অবস্থান নেন মুক্তিযোদ্ধারা। ভোরের আলো ফুটতেই টাইগার খ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর সিদ্দিক আহমেদের নেতৃত্বে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। ৯ ডিসেম্বর সকাল ১০টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে এই যুদ্ধ। সম্মুখসমরে শহরকে মুক্ত করতে গিয়ে আবু খাঁ, আব্দুল সাত্তার ও আব্দুর রশিদ তিনজন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আহত হন টাইগারখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু সিদ্দিক আহমেদ। মুক্তিযোদ্ধাদের দমে না-ফেরা প্রতিরোধে পাকিস্তানি বাহিনী পালাতে বাধ্য হয় ময়মনসিংহের দিকে।পরে মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে শহরে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলার সবুজ জমিনে লাল সূর্যখচিত পতাকা উত্তোলন করে নেত্রকোণা শহরকে মুক্ত ঘোষণা করে বিজয় উল্লাস করে।
প্রতি বছর দিবসটি পালনে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাজানো হয় নানা কর্মসূচি—আলোচনা সভা, শপথ অনুষ্ঠান, মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা এবং স্থানীয় তরুণদের অংশগ্রহণে স্মৃতিচারণ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের জেলা ইতিহাস অনুযায়ী, নেত্রকোনায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ৩ হাজার ৪২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। এর মধ্যে মুসলিম যোদ্ধা ২ হাজার ৯০৮ জন, হিন্দু ৪২৮ জন এবং আদিবাসী যোদ্ধা ছিলেন ৯১ জন। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন ৩৪ জন, আর সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে শহীদ হন মোট ৬৬ জন।
ইখা