চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানায় এখন নিয়ম-শৃঙ্খলার বদলে চলছে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি আর প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের রাজত্ব—তার সাম্প্রতিক নজির প্রায় ৪০ লাখ টাকার অবৈধ কাঠের চালান আটক ও রহস্যজনকভাবে তা ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা। এই অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া এএসআই আবু জাফর বেপারী হয়েছেন বলির পাঁঠা, অথচ মূল অভিযুক্ত ওসি মো. আফতাব উদ্দিন এখনও বহাল তবিয়তে দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
এর আগে, গত ২৫ জুলাই সময়ের কণ্ঠস্বরে প্রকাশিত ‘চট্টগ্রামে অবৈধ ৪০ লাখ টাকার কাঠ চালানের রফাদফা ৫ লাখে!’ শিরোনামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর স্থানীয়ভাবে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। এলাকাবাসী ও সচেতন মহলের দাবি ছিল, তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টোটা। অভিযুক্ত ওসির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে, বরং অবৈধ কাঠের ট্রাক জব্দকারী এএসআই আবু জাফর বেপারীকে ২৭ জুলাই হঠাৎ করে চান্দগাঁও থানার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, এবং তাকে সংযুক্ত করা হয় দামপাড়া পুলিশ লাইনে। এতে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, 'দায়ীদের রক্ষা করতেই কি একজন সৎ পুলিশ কর্মকর্তাকে বলির পাঁঠা বানানো হলো?'
কাঠ আটকের পর নাটকীয় মোড়
ঘটনার শুরু ২১ জুলাই রাত ২টা ৪৫ মিনিটে। চান্দগাঁও থানাধীন বহদ্দারহাট মোড়ে ডিউটিতে থাকা এএসআই আবু জাফর বেপারী ও তার টিম একটি কাঠবোঝাই ট্রাককে থামার সংকেত দেন। তবে ট্রাকটি সিগন্যাল অমান্য করে দ্রুত পালিয়ে যায়। পরে ধাওয়া করে বলিরহাট এলাকা থেকে সেটি আটক করা হয়।
পরে জানা যায়, আনুমানিক ৪০ লাখ টাকার কাঠের পুরো চালানটি অবৈধ। এরপর গোপনে শুরু হয় কাঠ মালিকপক্ষের দেনদরবার। তবে এএসআই আবু জাফর বেপারী অনড় থাকেন। তিনি স্পষ্ট বলেন, 'সব কিছু ওসি স্যারের সামনেই হবে, এখানে কোনো রফাদফা হবে না।'
এমনকী কাঠ ব্যবসায়ীরা থানার ক্যাশিয়ার এস্কান্দরকে ফোনে কথা বলিয়ে চেষ্টা চালালেও ব্যর্থ হন। পরে ভোর ৫টায় জব্দকৃত কাঠবোঝাই ট্রাকটি নিজেই থানায় নিয়ে আসেন এএসআই আবু জাফর।
পাঁচ লাখ টাকায় চালান ছাড়!
চিত্র বদলে যায় পরদিন রাতে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বৈধ কাগজপত্র যাচাই ছাড়াই এবং কোনো মামলা না করেই ২২ জুলাই রাতে কয়েক ঘণ্টা দরকষাকষির পর ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ট্রাকটি ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ‘ডিল’ সম্পন্ন হয় ওসি আফতাব উদ্দিন, এএসআই আবু জাফর ও সেকেন্ড অফিসার আব্দুল কুদ্দুসের উপস্থিতিতে, সেকেন্ড অফিসারের রুমেই।
সূত্র জানায়, ট্রাকটিতে পার্বত্য এলাকা থেকে অবৈধভাবে আনা সেগুন ও গর্জন কাঠ ছিল। এর আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু মামলা না করে ওসি আফতাবের নির্দেশে টাকার বিনিময়ে পুরো চালান ছেড়ে দেওয়া হয়। যার প্রমাণ সময়ের কণ্ঠস্বরের প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, 'আমাদের ওসি স্যারের কাছে আইন নয়, টাকা কথা বলে। অবৈধ কাঠের ট্রাকটি আমাদের সহকর্মী বৃষ্টির মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে আটক করেছিল। কিন্তু পরে সেটিই অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। নিউজ প্রকাশের দিন এএসআই আবু জাফরকে ওসি স্যার শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করেন। এখন তাকে ক্লোজ করে বাকিদের বাঁচানো হচ্ছে।'
থানায় টাকার রাজত্ব, সিন্ডিকেটের দাপট
চান্দগাঁও থানার প্রতিটি কাজেই টাকার প্রভাব স্পষ্ট। স্থানীয়দের অভিযোগ, থানার মামলা, অভিযোগ কিংবা আটককৃত আসামির মুক্তি—সবকিছুই নির্ভর করে টাকার অঙ্কের ওপর। এছাড়া বহদ্দারহাটের ফুটপাত দখল, মাদক ব্যবসা, জুয়াখেলার আসর এবং আবাসিক হোটেলে দেহব্যবসা—প্রতিটি খাতেই ওসি আফতাবের প্রভাব রয়েছে।
থানার একাধিক সাব-ইন্সপেক্টর নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, 'ওসির ভাগিনা এএসআই এনামুল হক, এসআই ফয়সাল আলম, সেকেন্ড অফিসার আব্দুল কুদ্দুস ও বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সের ইনচার্জ মো. ফয়সালের দাপটে সাধারণ পুলিশ সদস্যরা নিস্তেজ। তাদের পছন্দ না হলে যে কোনো সময় বদলির কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হয়।'
বহদ্দারহাট এলাকার হোটেল মালিক ও ব্যবসায়ীরা জানান, থানার নিয়মিত মাসোহারা না দিলে পুলিশ হানা দিয়ে হয়রানি করে। প্রতিটি আবাসিক হোটেল থেকে মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় হয়। কাঠের চালান, মাদক ব্যবসা এমনকি ফুটপাত দখলেও নির্ধারিত অঙ্কের ভাগ দিতে হয়।
একজন আবাসিক হোটেল মালিক অভিযোগ করে বলেন, 'মাসোহারা না দিলে পুলিশ অভিযান চালিয়ে অতিথিদের গ্রেপ্তার করে। আমাদের কষ্টার্জিত টাকার বড় অংশ থানার চাঁদায় চলে যায়। এখন তো শুনছি, যারা বিষয়টি প্রকাশ করছে, তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে। প্রতি মাসে ওসিকে যে চাঁদা দিতে হয়, তা কালেকশন করে ওসির গাড়ির ড্রাইভার সালাহউদ্দিন।'
স্থানীয় সুশীল সমাজ বলছে, ওসি আফতাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই অভিযোগ থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক ছায়ার কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বরং নিয়মিত অভিযান চালানোর নামে লোক দেখানো তৎপরতা চালিয়ে মূলত চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটকে রক্ষা করা হয়।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ঘটনাটি নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে আলোচনা চললেও এখন পর্যন্ত উচ্চপর্যায় থেকে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। পুলিশের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়লেও প্রশাসনের নীরবতা সিএমপি’র দুর্বলতা ও অসহায় অবস্থানকেই স্পষ্ট করছে।
এ বিষয়ে এএসআই আবু জাফরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'ভাই, ঘটনার পর থেকে আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। আপাতত এই বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।'
পরে মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) বিকেলে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি মো. আফতাব উদ্দিনও সময়ের কণ্ঠস্বরের প্রতিবেদকের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এসকে/আরআই