হারিয়ে যাচ্ছে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর স্মৃতিচিহ্ন, উদ্যোগ নেই সংরক্ষণের উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর স্মৃতিচিহ্ন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছেন ইতিহাসের পাতা থেকেও। নতুন প্রজন্ম তাঁর সম্পর্কে জানতে পারবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। তবে গুণী এই ব্যক্তির স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই প্রশাসন ও দায়িত্বশীলদের। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইবরাহীম খাঁর অনুরাগীরা।জানাযায়, কিংবদন্তি এই শিক্ষাবিদ তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থানার অন্তর্গত বিরামদী গ্রামে ১৮৯৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম শাবাজ খাঁ ও মায়ের নাম রতন খানম। ইবরাহীম খাঁ ১৯০৬ সালে জামালপুরের সরিষাবাড়ির পিংনা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ১৯১২ সাল পর্যন্ত সেখানে অধ্যয়ন করেন। সাহিত্যিক প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ প্রথম মুসলমান ছাত্র যিনি পিংনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রাস (বর্তমান এস.এস.সি) পাশ করেন। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ.পাস করেন। পরে ১৯২৪ সালে আইনে স্নাতক পাস করেন।ইবরাহীম খাঁ, শিক্ষা-সাহিত্য-ধর্ম-বিষয়ক প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণ কাহিনী, রসরচনা, গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস ও জীবনচরিত, শিশু সাহিত্য, পাঠ্য বই ও অনুবাদ মিলিয়ে শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। অনেক দায়িত্বপূর্ণ পদে কর্মব্যস্ত থেকেও নিরলসভাবে তিনি বিশাল সাহিত্য ভান্ডার রচনা করেছেন। সাহিত্যের সকল শাখায়ই তিনি স্বচ্ছন্দে সফলতার সঙ্গে পদচারণা করেছেন। মুসলমান সমাজের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের পুনর্জাগরণের প্রয়াস তার লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে।ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে মহাপ্রাণ মনীষী ইবরাহীম খাঁ কর্মজীবনের শুরুতেই অসহযোগ আন্দোলন এবং খেলাফত আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এই আন্দোলন তার গভীরভাবে জনজীবনের সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের ভিত তৈরি করে দেয়। সেই সময় মুসলিম মনে আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করার জন্য তিনি ইতিহাস, সমকালীন জীবন নিয়ে, ইসলামের গৌরবময় অধ্যায় নিয়ে লিখেছেন- এটাকেই তিনি তপস্যা বলেছেন। ব্রিটিশ ভারতে নিগৃহীত পণ্ডিতদেরকে তিনি তার কলেজে সুযোগ দিতেন- এমনকি অন্যত্র বহিষ্কৃত ছাত্ররাও তার আশ্রয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। তিনি তার নিজের বিশ্বাসে দৃঢ় ছিলেন, কিন্তু অন্যের মতবাদকে বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধা করতেন না। উদার মানবতাবাদী ইবরাহীম খাঁর সাহিত্যচর্চার প্রধান উৎসই শিক্ষা এবং সংস্কার- তিনি মূলত সংস্কারকই। অসংখ্য শৈবালদামে আচ্ছন্ন স্রোতধারার সংস্কারকেও কিছুটা বিপ্লবী ভূমিকা গ্রহণ করতে হয়- তিনি তা করেছেন।ইবরাহীম খাঁ ১৯১৯ সালে করটিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খাঁ পন্নীর অর্থসাহায্যে করটিয়া সা’দত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর প্রথম প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। মাঝে কিছুকাল তিনি ময়মনসিংহে আইনজীবী হিসাবে কাজ করেন। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনে (১৯২০-১৯২২) সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইবরাহীম খাঁ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৬ সালে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য এবং ১৯৫৩ সালে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া ১৯৪৭-১৯৭১ মেয়াদে তিনি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৮ সালে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ এলাকার বিদ্যোসাহী ব্যক্তিগণের অনুরোধে ভূঞাপুরের প্রাণকেন্দ্রে ‘ভূঞাপুর কলেজ’ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পর কলেজটির ‘ইবরাহীম খাঁ কলেজ’ নামকরণ করা হয়। একজন কৃতবিদ্য লেখক হিসেবেও ইবরাহীম খাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি বিভিন্ন লেখায় মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের কথা বলেছেন। নাটক, গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, ভ্রমণকাহিনী ও স্মৃতিকথা মিলে তাঁর গ্রন্থসংখ্যা শতাধিক। সেগুলির মধ্যে কামাল পাশা (১৯২৭), আনোয়ার পাশা (১৯৩৯), ঋণ পরিশোধ (১৯৫৫), আলু বোখরা (১৯৬০), ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র (১৯৫৪), বাতায়ন (১৯৬৭), ব্যাঘ্র মামা (১৯৫১) এবং বেদুঈনদের দেশে (১৯৫৬) প্রধান। তাঁর স্মৃতিকথা বাতায়ন সমকালের মুসলিম সমাজের একটি বিশ্বস্ত দলিল হিসেবে বিবেচিত। তিনি ব্রিটিশ আমলে ‘খান সাহেব’ ও ‘খান বাহাদুর’ এবং পাকিস্তান আমলে ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধি লাভ করেন। নাটকে অবদানের জন্য তিনি ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং সাহিত্যে ১৯৭৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৭৮ সালের ২৯শে মার্চ খ্যাতনামা এই শিক্ষাবিদ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।পাঠ্যবইয়ে এর আগে তাঁর লেখা গল্প স্থান পেলেও গত ১ দশকের অধিক সময় ধরে কোথাও কোনো পাঠ্যবইয়ে তার লেখা কোনো উপন্যাস, গল্প, স্থান পায়নি। এ নিয়ে স্থানীয় শিক্ষানুরাগী, কবি লেখকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।এ বিষয়ে লোকমান ফকির মহিলা ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং লেখক গোলাম রব্বানী রতন সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ ভূঞাপুরে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, মসজিদ, ক্লাবসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। এজন্য তাঁকে ভূঞাপুরের রুপকার বলাহয়। একটা সময় তার লেখা গল্প পাঠ্যবইয়ে ছাপা হত কিন্তু এখন আর হয়না। তাঁর অবমূল্যায় মেনে নেয়ার মত না। আমাদের দেশটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার দেশ। মানুষের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। রাজনীতির বিরুদ্ধে গেলেই তাঁকে সরিয়ে দেয়া হয়। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। সরকারের কাছে আবেদন, তাঁর লেখা গল্প যেন আবার পাঠ্যবইয়ে ছাপা হয়।ইবরাহীম খাঁ সরকারি কলেজে গিয়ে দেখা যায়, খোদ সেই কলেজের শিক্ষার্থীরাই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে কিছু জানেন না। তার জীবনী সম্পর্কে নেই কোন ধারণাও। ঐ কলেজের একাদশ শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থীদের কাছে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমাদের কলেজের প্রতিষ্ঠাতা একজন স্বনামধন্য লোক ছিলেন সেটা জানি, কিন্তু বিশদ আকারে জানিনা। আর আমাদের এ ব্যাপারে কলেজেও কোন ধারণা দেয়া হয়নি। আমরা পাঠ্যবইয়েও তার কথা পড়িনি। মাঝে মাঝে তাঁর জন্মদিন বা মৃত্যুদিনে মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে দায় সারে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে ইবরাহীম খাঁ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর কামরুজ্জামান সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, জ্ঞান তাপস প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর লেখা বাতায়ন, ইস্তাম্বুল পাঠ্যবইয়ে পড়েছি। পাঠ্যবইয়ে গল্প ছাপানোর কাজটা শিক্ষা বোর্ডের পলিসির উপর নির্ভর করে। পাঠ্যবইয়ে আবারও তাঁর লেখা ছাপা হলে আমরা খুশি হব। আমরা নিয়মিত তাঁর জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করি এবং আমাদের কলেজের বাৎসরিক পাঠ পরিকল্পনা আছে, সেখানে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর একটা অধ্যায় আছে শিক্ষার্থীদের জানার জন্য। জানা যায়, পৌরসভার অর্থায়নে ২০১৩ সালে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ স্মরণে তাঁর বাড়ির প্রবেশদারে ইবরাহীম খাঁর ছবি সম্বলিত দুটি ম্যূরাল নির্মাণ করেন। পরে তার নামকরণ করা হয় ইবরাহীম খাঁ তোরণ। পরিচর্যার অভাবে সেটিও বিলীন হবার পথে। এ নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগের শেষ নেই। আশেপাশে থাকা চায়ের দোকানসহ বাসা বাড়ির বর্জ্য এনে সেখানে ফেলা হয়। ম্যূরালের নিচের অংশের টাইলস ফাটলধরে খসে পড়ে গেছে অনেকাংশে। পৌর প্রশাসকের হস্তক্ষেপে পুনরুদ্ধার করার দাবী জানিয়েছেন স্থানীয়রাসহ তার পরিবারের লোকজন।তৎকালীন শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর নামে সাবেক মন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর সাহায্যে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে তার সমাধির পাশেই ইবরাহীম খাঁ স্মৃতি পাঠাগারটি রক্ষণাবেক্ষণ করে ভূঞাপুর পৌরসভা। অব্যবস্থাপনায় ধীরে ধীরে সেটিও হারিয়ে যাচ্ছে।এ বিষয়ে তার পরিবারের উল্লেখযোগ্য সদস্য কিংশুক খান সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, আমার একদিন সৌভাগ্য হয়েছিল পাঠাগারে যাওয়ার। পাঠাগারেও যে তার বই খুব একটা আছে তা নয়। এটা আমার মনে হয় পাঠাগার কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা। আমাদের সাথেও তেমন যোগাযোগ করে নাই, তাহলে আমরাও চেষ্টা করতাম। কলেজ প্রতিষ্ঠা করা তাঁর জীবনের একটা স্বপ্ন ছিল, কলেজেও যে খুব একটা বই আছে সেটাও না। এটাও কলেজ কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা। কলেজ কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে বই সংরক্ষণ করেছে তা নয়। আমরা চেষ্টা করতেছি তার যে পৈতৃক বাড়ি আছে সেটা তার স্মৃতিস্বরূপ একটা জাদুঘর তৈরি করার। সেখানে তার বই, এবং তার ব্যবহারের আসবাবপত্র থাকবে। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর একটা সংগঠন আছে ইবরাহীম খাঁ একাডেমি সেন্টার সেটার উদ্যোগে প্রতিবছর আমরা বড় আয়োজন করে অনুষ্ঠান করি। সেখানে ভূঞাপুরের লোকজনের সাড়া তেমন পাইনা তবে করটিয়া এবং ঢাকার লোকজনের সাড়া পাই।