গাজীপুরের টঙ্গীর টিঅ্যান্ডটি কলোনি জামে মসজিদের খতিব মুফতি মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজী (৬০) নিজেই অপহরণের নাটক সাজিয়ে ছিলেন। তিনি নিজেই নিজের পায়ে শিকল লাগিয়ে শুয়ে ছিলেন—এসব কিছুই তার নিজের পরিকল্পিত কাজ। তাকে পঞ্চগড়ে কেউ নিয়ে যায়নি বলে তদন্তে যুক্ত পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
মুহিব্বুল্লাহ অপহরণের যে বর্ণনা দিয়েছেন এবং যে সময় ও স্থান থেকে তাকে তুলে নেওয়ার কথা বলেছেন, সেই সময়ের ওই এলাকার একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে পুলিশ অপহরণের কোনো প্রমাণ পায়নি।
মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজী সামাজিক মাধ্যমে মাওলানা মুফতি মুহিব্বুল্লাহ মাদানী নামেই বেশি পরিচিত।
তিনি দাবি করেছিলেন, গত ২২ অক্টোবর সকাল ৭টার দিকে টঙ্গীর শিলমুন এক্সিস লিংক সিএনজি ফিলিং অ্যান্ড কনভার্সন সেন্টারের সামনে থেকে তাকে অপহরণ করে একটি অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে নেওয়া হয়। পরদিন পঞ্চগড়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধারের কথাও নিজেই সংবাদমাধ্যমে জানান।
তিনি আরো দাবি করেন, অপহরণের আগে টানা কয়েকদিন একের পর এক উড়ো চিঠির মাধ্যমে হুমকি পেয়েছিলেন এবং অপহরণের পর গোটা একটি দিন নির্যাতনের শিকার হন।
তবে মঙ্গলবার সকালে অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের ওই সময় ও এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দাবি করেছেন— মুফতি মুহিব্বুল্লাহ অপহৃত হননি।
তিনি জানান, মহিবুল্লাহ মিয়াজী নিজের অপহরণের বিষয়ে যে বিবরণ দিয়েছেন, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি।
ওই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ শেয়ার করে সায়ের বলেন, গাজীপুরের টঙ্গীর টিঅ্যান্ডটি কলোনি জামে মসজিদের খতিব মুফতি মোহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজী দাবি করেছিলেন গত ২২ অক্টোবর ২০২৫ সকাল ৭টার দিকে টঙ্গীর শিলমুন এক্সিস লিংক সিএনজি ফিলিং অ্যান্ডকনভার্সন সেন্টারের সামনে থেকে তাকে অপহরণ করে একটি অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হয়। তবে উক্ত এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় সকাল ৬টা ৫২ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে তিনি ঘর থেকে বের হন। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় তিনি বাম হাতে দরজা খুলে বের হন, পেছন ফিরে তাকাননি এবং টিনের দরজাটি বন্ধ হয়ে যায়।
সকাল ৬টা ৫৩ মিনিট ২৫ সেকেন্ডে তিনি মসজিদ ছাড়েন এবং প্রায় ৬টা ৫৪ মিনিটে টঙ্গী টু কালীগঞ্জগামী আঞ্চলিক সড়কে কালীগঞ্জের দিকে রওনা হন। পরনে ছিল সাদাপাঞ্জাবি-পাজামা, মাথায় কালো রঙের পাগড়ি।
সায়ের আরো জানান, মুহিব্বুল্লাহর বাসার অদূরে শিলমুন এক্সিস লিংক সিএনজি ফিলিং অ্যান্ড কনভারশন সেন্টারের চারটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজেও এজাহারে উল্লেখিত অপহরণের বর্ণনার মিল পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে নেওয়া চারটি ফুটেজ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সকাল ৭টা ১৮ মিনিটে মুহিব্বুল্লাহ পাম্পের সামনে দিয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছেন।
ফিলিং স্টেশনের সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্স পথরোধ করে তাকে অপহরণের যে দাবিটি করা হয়েছে, সিসিটিভি ফুটেজে এরকম কোনো ঘটনা দেখা যায়নি। বরং তাকে একাই দ্রুত গতিতে হেঁটে যেতে দেখা গেছে। সামনের সেতুর উপরে পুলিশের স্থাপন করা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায় মুহিব্বুল্লাহ একাই হাঁটছেন। অথচ এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন, ফিলিং স্টেশনের সামনে তাকে অপহরণ করা হয়। ৬টা ৫৪ মিনিটে এলাকা থেকে রওনা হয়ে তিনি প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ফিলিং স্টেশনে পৌঁছান সকাল ৭টা ১৮ মিনিটে।
ফিলিং স্টেশনের ব্যবস্থাপক মো. সোলেইমান নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যদের জানান, ‘তিন দফায় পুলিশের বিভিন্ন শাখা আমাদের সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ করে, আমাদের ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে হুজুরকে অপহরণ করা হয়নি।’
টিঅ্যান্ডটি বাজার জামে মসজিদের খতিব মুফতি মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজী নিজেই পঞ্চগড়ে গিয়েছিলেন বলে স্বীকার করেছেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমি হাঁটতে গেছি। হাঁটতে যাওয়ার পরে আমার মাথায় আসলো যে আমি চলতে থাকি, যাই। কোন দিকে যাই, বলতে পারি না। একপর্যায়ে আমি অটো পাইছি, অটোতে উঠছি, মীরের বাজার নামছি। নামার পরে মনে চাইল যে আমি জয়দেবপুর যাই। সিএনজি দিয়ে জয়দেবপুর গেছি। এরপরে আমার মাথায় আসলো যে আমি এখন এই বাসে উঠি। বাসে উঠে শ্যামলী না কোন যায়গায় যেন নামাইছে। এইখান থেকে আমি আরেকটা বাসে উঠে গাবতলী গেছি। ওইখান থেকে আমি মনে চাইল যে আমি টিকিট করি। কই যাব, খেয়াল হইল যে আমি পঞ্চগড় যাই।অনেক রাতে পঞ্চগড় নামছি। নামার পরে হাঁটতেছিলাম, কোন দিকে হাঁটতেছি আমি জানি না চিনি না, হাঁটতেছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে আমি দেখি যে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ লাইনস এগুলো হেঁটে পার হয়ে গেছি। পার হয়ে গিয়ে আমি একটা শিকল কুড়িয়ে পাইলাম। ওইটা নিয়ে আমি এক যায়গায় প্রস্রাব করতে বসলাম। প্রস্রাব করলাম আর পায়জামায় প্রস্রাব লাগল, এর পরে জামায়ও লাগল। জামা খুইলা ফালাইলাম, পায়জামাও খুললাম। কিন্তু খোলার পরে আবার পরতে হবে এই জিনিসটা আমি আর পারি নাই ঠাণ্ডায়। ঠাণ্ডায় ওইখানে শুইয়া পড়লাম আর পায়ে শিকল দিলাম। এইটা কেন করতেছি এইটার কোনো চিন্তাভাবনা আমার নাই, খালি যা মাথায় আসতেছে তা করতেছি।’
এ বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার জাহিদুল ইসলাম প্রেস ব্রিফিং এর মাধ্যমে বিস্তারিত জানাবেন বলে জানিয়েছেন।
ইখা