সমুদ্রে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে ট্রলার তৈরিতে বিনিয়োগ করছেন ভোলার চরফ্যাশনের মৎস্যজীবিরা। নতুন ট্রলার তৈরির পাশাপাশি পুরাতন ট্রলার মেরামতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কাঠমিস্ত্রীরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব কাজ চলছে স্থানীয় ডকইয়ার্ডগুলোতে। সমুদ্রে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেই সমুদ্র দাপিয়ে বেড়াবে এসব ট্রলার।
বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) দুপুরে উপজেলার বেতুয়া, নতুন স্লুইজ, সামরাজ ও খেজুর গাছিয়ার মৎস্যঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নতুন ট্রলার তৈরির পাশাপাশি পুরাতন ট্রলার মেরামতের কাজ চলছে পুরোদমে। বেতুয়া মৎস্যঘাট থেকে সামরাজ মৎস্যঘাট পর্যন্ত বেড়িবাঁধের ঢালে প্রায় শতাধিক ট্রলার তৈরি হচ্ছে। নির্মাণাধীন এসব ট্রলার মেরামতের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন কাঠমিস্ত্রী ও তাদের সহযোগীরা। তারা কেউ কাঠ মসৃণ করছেন, কেউবা কাঠ জোড়া লাগানোর কাজ করছেন।
সামরাজ মৎস্যঘাট সংলগ্ন নদী তীরে আব্দুল মাঝির নতুন একটি ট্রলার তৈরির কাজ করছেন কাঠমিস্ত্রী মোবাশ্বর (৪৮)। তিনি বলেন, এ উপজেলায় প্রায় দেড় শতাধিক কাঠমিস্ত্রী রয়েছে। সকলেই এখনে ট্রলার তৈরি ও মেরামতের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। তাদের পাশাপাশি আরও অন্তত ২ শতাধিক হেলপার এ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। প্রতিবছর এ সময়ে ট্রলার তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। একটি ট্রলার তৈরি করতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। ট্রলার আকার ও প্রকার ভেদে মজুরি নেওয়া হয়। তাতে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা মজুরি আসে। ট্রলার মহাজনের কাছ থেকে কাঠমিস্ত্রীর মজুরি দৈনিক জনপ্রতি ১ হাজার ২০০ টাকা এবং সহযোগীদের মজুরি ৮০০ টাকা নেয়া হয়। এবছর তুলনামূলক নতুন ট্রলার তৈরি বেশি হচ্ছে। গতবছর এমন দিনে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মিস্ত্রী ও সহযোগী এনে ট্রলার তৈরি কাজ করেছি।
ট্রলার মালিক আব্দুল মাঝি বলেন, মৎস্য আহরণ করে আমরা জীবিকা নির্বাহ করি। এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে ট্রলার জড়িত। বর্তমানে নদীতে মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা চলে এজন্য জেলেরা অবসর সময় পেয়ে আগে-ভাগে নতুন ট্রলার তৈরি ও পুরাতন ট্রলার মেরামত করছে।
তিনি আরও বলেন, গত বছর আমার ছোট একটি ট্রলার থাকায় গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ শিকার করতে পারি নাই। এবছর সিদ্ধান্ত নিয়েছি গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ শিকার করবো। তার জন্য বড় একটি নতুন ট্রলার তৈরি করছি। ট্রলারটি ৩৪ ফুট লম্বা, ১৫ ফুট চওড়া, ট্রলার তৈরি করতে প্রায় ৫শ সেফটি মেহেগুনি, ও রেন্টি কাঠ লাগছে। প্রায় ১শ কেজি আলকাতরা লাগছে। ট্রলারটিতে ৪০ গড়া একটি চায়না ইঞ্জিন, একটি ২৬ গিয়ার লাগবে। এতে প্রায় ১২ লাখ টাকা খরচ হবে। ট্রলার তৈরি করতে ১২ জন কাঠমিস্ত্রী নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের থাকা-খাওয়া বাদে মিস্ত্রিকে ১ হাজার ২০০ টাকা, আর সহযোগীর ৮০০ টাকা দৈনিক মজুরি দিতে হয়ে।
নতুন স্লুইজঘাটে ট্রলার মেরামত করছেন ট্রলার মাঝি সবুজ (৩৪)। তিনি বলেন, নদীতে মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা চলছে। তাই কর্মহীন হয়ে পড়েছি। সেই সুযোগে আমার ট্রলারটি মেরামত করছি। আমার এই ট্রলারটি মেরামত করতে ২০-২৫ দিন সময় লাগবে। ট্রলার মেরামতে প্রায় ৫০ কেজি পেরেক, ৫০ কেজি সুতা প্রয়োজন হবে। মিস্ত্রী খরচ সহ সবমিলিয়ে ১ লাখ টাকা খরচ হবে। সামরাজ এক মৎস্য ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দাদন নিয়েছি, বর্ষায় সাগরে মাছ ধরে পরিবারের ভরনপোষণ করণসহ আড়ৎদারের টাকা পরিশোধ করবো।
সামরাজ মৎস্যঘাটে জহির উদ্দিন নামে এক মৎস্য ব্যবসায়ী বলেন, এ উপজেলার প্রায় ১ লাখ পরিবারের আয়ের উৎস্য সমুদ্রে মাছ ধরা। বর্ষা মৌসুমে জেলেরা সাগরে বিপদের সঙ্গে লড়াই করে জীবিকা অর্জন করতে হয়। সামনের মৌসুমে গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের জন্য এখানকার মৎসজীবিদের সাগরযাত্রার মহাকর্মযজ্ঞের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মৎস্য আড়ৎ মালিকদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে কেউ নতুন ট্রলার বানাচ্ছে কেউবা পুরানো ট্রলারকে মেরামতে করছেন। জেলেদের মনে বড় আশা সাগরে মাছ ধরে জীবিকা-নির্বাহ করাসহ আড়ৎদারের দাদন পরিশোধ করবেন।
এ বিষয়ে চরফ্যাশন উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু বলেন, এ উপজেলার মৎস্যজীবিদের সাগরযাত্রার মহাকর্মযজ্ঞের প্রস্তুতি চলছে। এতে কেউ নতুন, কেউ পুরাতন ট্রলার মেরামত করছেন। এসব কাজে নিয়োজিত রয়েছেন কাঠমিস্ত্রীরা। তাদের কাজের সুবিধার্থে এ উপজেলায় সরকারিভাবে কোনো ডকইয়ার্ড দেয়া যায় কি না উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করা হবে।
এসআর