বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ ঘিরে সামনে রেখে চৈত্রের পুরোটা সময় কর্মব্যস্ততায় কাটতো টাঙ্গাইলের মৃৎশিল্পীদের। পুরো মাস জুড়ে চলতো মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় খেলনা আর তৈজসপত্র বানানোর কাজ। তবে সেই চিত্র এখন পুরোপুরি পালটে গিয়েছে। বাজারে এসব পণ্যের জায়গা দখল করেছে প্লাস্টিক পন্য। চাহিদা না থাকায় ধীরে ধীর হারিয়ে যেতে বসেছে এসব মৃৎশিল্প। এদিকে মাটির তৈরি খেলনার কদর কমে যাওয়ায় তাদের এখন অনেকটা ভরসা দইয়ের হাড়ি ও কুয়ারপাট।
কালের আর্বতে এই শিল্প দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে মাটির তৈরি এই জিনিসপত্রের ব্যবহার কমে গেছে। যার ফলে অনেক শিল্পী এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। শত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনবদ্য রূপ মৃৎশিল্প। এর সঙ্গে একদিকে জড়িয়ে রয়েছে জীবনের প্রয়োজন, অন্যদিকে নান্দনিকতা ও চিত্রকলার বহিঃপ্রকাশ। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নিয়ে পেশাটি বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
টাঙ্গাইলের কালিহাতীর পৌর এলাকা উত্তর বেতডোবা, কোকডহরা , নারান্দিয়া , বল্লা , নাগবাড়ী ইউনিয়নে এখনো কয়েকশত কুমার পরিবার এই শিল্পটাকে ধরে রেখেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাটির তৈরি তৈজসপত্রকে যুগোপযোগী করে তুলতে পৃষ্ঠপোষকতা করা গেলে পরিবেশের উপর প্লাস্টিকের যে বিরূপ প্রভাব তা অনেকটাই কমানো সম্ভব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনো কালিহাতী উপজেলার কালিহাতী পৌরসভার উত্তর বেতডোবার ৪০টি পরিবার, কোকডহরা ইউনিয়নের ৫০টি পরিবার, নারান্দিয়া ইউনিয়নের পালিমা ও পাথালিয়া গ্রামে প্রায় ১০০টি পরিবার, বল্লা ইউনিয়নের বল্লা পাল পাড়ায় ৯০টি পরিবার, নাগবাড়ী ইউনিয়নের ঘোনাবাড়ীতে ১৬টি কুমার পরিবার বসবাস করে আসছেন।
বল্লা পাল পাড়ার প্রফুল্ল পাল, আলো পাল, কার্তিক পাল, সাধন পাল, সুনীল পাল ও নারায়ণ পালের সাথে রোববার (১৩ এপ্রিল) দুপুরে কথা বলে জানাযায়, পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এ সমপ্রদায়ের লোকজনেরা মাটির তৈরি করা পাকপাতিল, ঠিলা, কলসি, পুতুল, কুয়ার পাট, খেলনার সামগ্রী, ফুলের টব, মাটির ব্যাংক ইত্যাদি হাট বাজারে বা গ্রামে গ্রামে বড় ঝাঁকা বোঝাই করে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন। ছয়মাস ধরে তারা মৃৎশিল্প তৈরি করে আর ছয়মাস বিভিন্ন কায়দায় বিক্রি করতেন। দিন যতই যাচ্ছে, ততই বাড়ছে আধুনিকতা। আর এই আধুনিকতা বাড়ার সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির তৈরি শিল্পপণ্যগুলো।
কালিহাতী উপজেলার উত্তর বেতডোবার সুরেশ পাল বলেন, ব্যবসা মন্দার কারণে আমাদের এখানকার মৃৎশিল্প প্রস্তুতকারী শতাধিক পরিবার পৈত্রিক ভিটা পর্যন্ত ছেড়ে চলে গেছে। প্রায় ৪০০ পরিবারের মতো অন্য পেশায় চলে গেছে। এখন বাপ-দাদার এই পেশা ধরে রেখেছে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার। বিভিন্ন জায়গা থেকে মাটি কিনে আনতে হয়। সব কিছুর দাম বাড়ছে, তবে আমাদের মাটির জিনিসের দাম বাড়েনি। এমনিতেই মাটির জিনিস চলে না, তার উপর দাম বাড়ালে লোকে কিনেও না। কোনোমতে দইয়ের হাড়ি বিক্রি করে বেঁচে আছি।
বর্তমানে কাঠের ও মাটির দাম বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে।’ বাজারে মাটির পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় তাদের এ ব্যবসা এখন হুমকির মুখে। ভবিষ্যতে এ পেশা থাকবে কি না তা নিয়ে নিজেরাই রয়েছেন সংশয়ে। তারপরও তাদের ধারণা, সরকারের বিসিক বা অন্য কোন সংস্থা যদি সহযোগিতা করে তাহলে তারা আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ খায়রুল ইসলাম জানান, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনবদ্য রূপ মৃৎশিল্প। এর সঙ্গে একদিকে জড়িয়ে আছে জীবিকা, অন্যদিকে নান্দনিকতা ও চিত্রকলার বহিঃপ্রকাশ। মৃৎশিল্প বাঙালির নিজস্ব শিল্প, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের অংশ। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে।
হস্তশিল্পের সাথে য়ারা জড়িত আছে তাদেরকে আরও কিভাবে সরকারিভাবে সহযোগিতা করা যায় সেই চেষ্টা আমাদের থাকে। তারা যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে কর্মসংস্থান ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে তারা যেন সহজে ঋণ পায় সহযোগিতা করা হবে।
এসআর