রাজশাহীর পবা নার্সারির শান্ত সবুজ প্রান্তরে মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) সকালটা যেন হয়ে উঠেছিল এক ইতিহাসের সাক্ষী। দেশের প্রথম ঘড়িয়াল প্রজনন কেন্দ্রের দ্বার আজ আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হলো বাংলাদেশ ঢাকা বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরীর হাত ধরে। গাজীপুর সাফারি পার্ক থেকে আনা দুটি পূর্ণবয়স্ক ঘড়িয়াল—একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী—এই কেন্দ্রে অবমুক্ত করার মধ্য দিয়ে সূচিত হলো একটি নতুন অধ্যায়।
উপস্থিত ছিলেন বন অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পরিবেশবাদী সংস্থার প্রতিনিধিরা। কারও চোখেই লুকানো ছিল না এই ক্ষুদ্রতর সরীসৃপের জন্য এই কেন্দ্র কতটা তাৎপর্যপূর্ণ হতে চলেছে।
ঘড়িয়াল, বৈজ্ঞানিক নাম Gavialis gangeticus, জলজ পরিবেশের এক শান্ত স্বভাবের বাসিন্দা। লম্বা সরু চোয়াল আর জলচর জীবনে নিখুঁত অভিযোজন এই প্রাণীটিকে আলাদা করেছে অন্যসব কুমির প্রজাতি থেকে। একসময় বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে ঘড়িয়ালের অবাধ বিচরণ ছিল। কিন্তু সময়ের নিষ্ঠুরতায় এখন সেটি ইতিহাস।
নদীর পানি দূষণ, অতিরিক্ত মাছ আহরণ, অবৈধ শিকার, ডিম নষ্ট করে দেওয়া, প্রজননের সময় আশ্রয়স্থল নষ্ট হওয়া—সব মিলিয়ে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে এই প্রজাতিটি। আন্তর্জাতিক সংস্থা CITES একে Appendix-1 ভুক্ত করেছে, যা নির্দেশ করে এটি বাণিজ্যিকভাবে অতি সুরক্ষিত প্রাণী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২-তেও এটি একটি রক্ষিত প্রাণী।
প্রথম ঘড়িয়াল প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে রাজশাহীর এই উদ্যোগ যে শুধু ঘড়িয়াল সংরক্ষণের জন্য নয়, বরং তাদের প্রজননের মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশে ফেরত পাঠানোর একটি দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নিয়েই যাত্রা শুরু করেছে, তা বলাই বাহুল্য। ঢাকা আগারগাঁও বনভবন, প্রকল্প পরিচালক ও উপপ্রধান বন সংরক্ষক গোবিন্দ রায় জানান, “আমরা শুধু সংরক্ষণে থেমে থাকবো না। এই কেন্দ্রে প্রজননের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল জনসংখ্যা গড়ে তোলা হবে, এবং সময়মতো উপযুক্ত নদীতে তাদের অবমুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।”
এ সময় উপস্থিত ঢাকা সাভার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান বলেন, “ঘড়িয়ালের প্রজনন নিয়ে গবেষণার সুযোগও তৈরি হবে এই কেন্দ্রে। এটি শুধু সংরক্ষণের জায়গা নয়, গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রমেরও কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।”
ঘড়িয়াল প্রজনন কেন্দ্রকে ঘিরে একটি পরিবেশ সচেতনতা আন্দোলন গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ. এম সালেহ রেজা। “শুধু সরকার বা বিজ্ঞানীদের পক্ষে এই প্রাণীকে বাঁচানো সম্ভব নয়। স্থানীয় মানুষ, শিক্ষার্থী, পরিবেশপ্রেমী সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে,”—বলছিলেন তিনি।
এজন্য কেন্দ্রটিকে শিক্ষনীয় সফরের স্থান হিসেবেও গড়ে তোলা হবে বলে জানান রাজশাহী সামাজিক বন বিভাগ ও বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা মো. রফিকুজ্জামান শাহ। ইতোমধ্যেই স্থানীয় স্কুল-কলেজ থেকে আগ্রহ জানানো শুরু হয়েছে।
ঘড়িয়ালের মতো একটি স্পর্শকাতর ও বিপন্ন প্রজাতির প্রজনন সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন নিবিড় পর্যবেক্ষণ, বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। IUCN বাংলাদেশ-এর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর এবিএম সরোয়ার আলম বলেন, “বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এই প্রজাতির প্রজনন শুরু হওয়ায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন হবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু কেন্দ্র স্থাপন করলেই হবে না, প্রাকৃতিক পরিবেশেও ঘড়িয়ালের বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। পদ্মা বা যমুনার মতো বড় নদীগুলোতে ঘড়িয়ালের জন্য আলাদা সংরক্ষিত এলাকা নির্ধারণ করার দাবিও উঠে এসেছে।
বগুড়া সামাজিক বন অঞ্চলের বন সংরক্ষক মুহাম্মদ সুবেদার ইসলাম, ঢাকা বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. ছানাউল্ল্যা পাটওয়ারী, রাজশাহী সেভ দি ন্যাচার এন্ড লাইফের চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান এসময় উপস্থিত ছিলেন।
তাঁরা জানান, ঘড়িয়াল শুধু একটি প্রাণী নয়; এটি আমাদের নদী ব্যবস্থার স্বাস্থ্য ও ভারসাম্যের নির্দেশক। নদীতে ঘড়িয়ালের উপস্থিতি মানে, সেই নদী এখনো জীবিত, খাদ্যশৃঙ্খল এখনো সচল। তাই রাজশাহীতে এই প্রজনন কেন্দ্র শুধু একটি প্রকল্প নয়, বরং একটি দেশের পরিবেশ ভাবনার প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশে ঘড়িয়াল ফিরিয়ে আনার এই পদক্ষেপ সফল হলে, তা পরিবেশ রক্ষায় এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। হয়তো একদিন আমরা আবারও দেখতে পাব নদীর কিনারায় একঝাঁক সদ্য জন্ম নেয়া ঘড়িয়াল তাদের নতুন জীবনের পথ খুঁজছে—নিরাপদ, স্বাভাবিক ও স্বাধীনভাবে।
এই যাত্রা দীর্ঘ, পথ কঠিন। তবে রাজশাহী থেকে শুরু হওয়া এই প্রথম পদক্ষেপ আমাদের জানিয়ে দিল, এখনও সময় আছে হারিয়ে যাওয়া প্রাণকে ফিরিয়ে আনার। ঘড়িয়াল এখন আর শুধু ইতিহাস নয়—এটি ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও।
এসআর