ময়মনসিংহের ত্রিশাল পৌরসভার নওধার গ্রামের পরিশ্রমী কৃষক তমিজ উদ্দিন। কঠোর পরিশ্রম ও সঠিক উপায়ে সবজি চাষ করে ইতিমধ্যে পেয়েছেন ব্যাপক সফলতা। প্রায় দেড় একর জায়গা জুড়ে বিভিন্ন মৌসুমী সবজি চাষে তার এই সফলতার পেছনে রয়েছে স্থানীয় কৃষি অফিসের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও তার দুই শিক্ষিত ছেলের কৃষি কাজে সম্পৃক্ততা।
নিরাপদ সবজি চাষে তাদের সফলতা দেখে তার গ্রামের আশেপাশের অনেকেই এখন অনুপ্রানিত হয়ে বানিজ্যিক ভাবে চাষাবাদ শুরু করেছেন। আধুনিক প্রযুক্তিতে কৃষি কাজে সম্পৃক্ত হতে পেরে তমিজ উদ্দিনের ছেলেরাও জানিয়েছেন তাদের ভালোলাগার কথা।
কঠোর পরিশ্রমী কৃষক তমিজ উদ্দিনের সফলতাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে স্থানীয় কৃষি অফিস বাড়িয়ে দিয়েছে সফলতার হাত। সারা বছরব্যাপী সবজি উৎপাদন ঠিক রাখতে এবং উচ্চ মূল্যের সময়ে ফসল উৎপাদন ও গুরুত্বপূর্ণ সবজির চারা উৎপাদন করতে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় ১০ শতক জায়গা জুড়ে একটি পলিনেট হাউজ করে দিয়েছে তারা।
বিশ্ববাজারে অর্গানিক (জৈব) সবজি ও ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। জৈব প্রযুক্তিতে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দামও তুলনামূলক বেশি। অন্যদিকে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ।
এমন বাস্তবতায় নিরলস শ্রম ও জৈব প্রযুক্তি ব্যাবহার করে পরিকল্পিত চাষাবাদে সফলতা অর্জন করে অনেক কৃষকের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন কৃষক মোঃ তমিজ উদ্দিন। কৃষক তমিজ উদ্দিন জানান তার এই সফলতার পেছনে রয়েছে ত্রিশাল কৃষি অফিসের নিবিড় পর্যবেক্ষন ও সহায়তা প্রদান। তিনি প্রায় দেড় একর জায়গা জুড়ে বিভিন্ন মৌসুমী সবজি আবাদ করছেন।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রবি মৌসুমে তমিজ উদ্দিনের উৎপাদিত সবজির মধ্যে রয়েছে টমেটো, বিভিন্ন জাতের বেগুন, শসা, লাউ, মরিচ, পেয়াজ ইত্যাদি। প্রকল্পভুক্ত এসব সবজিক্ষেতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ভার্মি কম্পোস্ট। ক্ষতিকর পোকা-মাকড় দমনের জন্য রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ, হলুদ আঠালো ফাঁদ, জৈব বালাইনাশক, ইকোমেকস, বায়োট্রিন ইত্যাদি।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণার অংশ হিসেবে পেয়াজ ও বিভিন্ন জাতের বেগুন চাষের উপযোগিতা যাচাইয়ে গবেষণার জন্য বেছে নিয়েছেন কৃষক তমিজ উদ্দিনকে। তাকে বিনা মূল্যে বিভিন্ন জাতের সবজির চারা উৎপাদনের জন্য বীজ, কেঁচো সার, সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ, জৈব বালাইনাশক দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যবহার পদ্ধতির ওপর হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তাকে। শেখানো হয়েছে ফাঁদ স্থাপনের কায়দা-কৌশল।
চাকরির পিছনে না ছুঁটে কৃষক তমিজ উদ্দিনের দুই ছেলে রেজাউল করিম ও সিরাজুল ইসলাম শামীম এখন কৃষিতেই স্বপ্ন বুনছে। আশা করছেন নিরাপদ সবজি উৎপাদন করেই বছরে আয় করবেন কয়েক লাখ টাকা।
স্থানীয় কৃষক আবুবকর সিদ্দিক বলেন, ‘তমিজকে দেখেই আমরা বিভিন্ন সবজি চাষ শুরু করেছি। উনার শিক্ষিত ছেলেরাও কৃষি কাজে নিয়মিত সময় দেয়। উনার কলাকৌশল ও সফলতার গল্প এখন এলাকার মানুষের মুখে মুখে। আমরাও চেষ্টা করছি উনার মতো ভালো ও আদর্শ কৃষক হয়ে উঠার জন্য।'
কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, 'তমিজ উদ্দিনের টানের(উচু শ্রেণির) জমি বেশি। প্রায় দেড় একর টানের জমিতে বৃষ্টির পানি না জমার কারণে তার ফসল ভালো হয়।'
তমিজ উদ্দিনের ছেলে রেজাউল করিম বলেন, 'রাসায়নিক সার ব্যবহার না করেও আমরা অনেক ভালো ফলন পাচ্ছি। এতে পরিবেশের ক্ষতি এড়ানো যাচ্ছে। খরচও তুলনামূলক কম পড়ছে। আবার আমাদের জমির মাটিও ভালো থাকছে।’
কৃষক তমিজ উদ্দিন বলেন, 'স্থানীয় কৃষি অফিসের সহায়তায় আল্লাহর রহমতে কৃষি কাজ করে আমি ভালোই সফলতা পেয়েছি। আমার দুই ছেলে কৃষি কাজে আমাকে সহায়তা করে। আধুনিক কৃষি লাভজনক হওয়ায় চাকরির খোঁজ না করে আমার শিক্ষিত দুই ছেলে আমার সাথে এ পেশায় সম্পৃক্ত হয়েছে। সরকারি সহায়তায় পাওয়া পলিনেট হাইজ ব্যবহার করে এ অঞ্চলে নিরাপদ ফসল উৎপাদনে বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা করবো।'
ত্রিশাল উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিন বলেন, তমিজ ভাই অনেক পরিশ্রমী কৃষক। উনার দুই ছেলেকে নিয়ে সবজি চাষ করে উনি সফলতা পেয়েছেন। তার ছেলেরা শিক্ষিত হয়েও কৃষি কাজে জড়িয়েছেন। তার শ্রম ও উদ্যম দেখে তাকে সরকারি ভাবে একটি পলিনেট হাউজ করে দেওয়া হয়েছে। আশা করছি এখন থেকে সে সারাবছরই সবজি উৎপাদন করে বাজারজাত করতে পারবে।'
ত্রিশাল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানিয়া রহমান বলেন, 'কৃষক তমিজ উদ্দিন একজন সফল কৃষক। একজন ভালো সবজি উৎপাদনকারী হিসেবে উনার সুনাম আছে। এটার উপর ভিত্তি করে আমরা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকর প্রকল্পের আওতায় ১০ শতক জমিতে একটি পলিনেট হাউজ নির্মাণ করে দিয়েছি। এই পলিনেট হাউজটিতে উনি উচ্চ মূল্যের ফসল আবাদ করবেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফসলের চারা উৎপাদন করবেন। উনি যেহেতু সবজির ভালো উৎপাদন করে থাকেন তাই আশা করছি উনার উপর আমরা যে ভরসাটুকু করেছি উনি তা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হবেন।'
এআই