রাজশাহীর সীমান্তবর্তী গোদাগাড়ী উপজেলার নিভৃত এক গ্রাম তিরিন্দা ভাজানপুর। এক সময় এই গ্রাম পরিচিত ছিল তার সবুজ ক্ষেত আর কৃষক মনমানসিকতার জন্য। তবে গত কয়েক বছর ধরে এই গ্রামকে ঘিরে ছায়া ফেলতে শুরু করে এক অদৃশ্য শক্তি মাদকের ভয়াল থাবা। আর সেই অন্ধকার সাম্রাজ্যের কথিত গডফাদার মো. তারেক হোসেন অবশেষে ধরা পড়েছেন ৬.৫ কেজি হেরোইনসহ, যা রাজশাহীর ইতিহাসে হেরোইনের সবচেয়ে বড় চালান।
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) বিকাল ৩টায় রাজশাহী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. গোলাম আজম, রাজশাহী বিভাগীয় উপপরিচালক মোহা. জিললুর রহমান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব: প্রশাসন, অর্থ ও পরিকল্পনা) মো. মাসুদ হোসেন এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা।
সকাল ৮টা গোদাগাড়ীর তিরিন্দা ভাজানপুর গ্রামের বাতাস তখনো কুয়াশাচ্ছন্ন। হঠাৎ করেই শুরু হয় তল্লাশি অভিযান। স্থানীয়রা প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় আসল চিত্র তারেক হোসেনের বাড়ি এবং নিজস্ব মার্কেট থেকে গম ও ভুট্টার বস্তার নিচে লুকানো ছিল কোটি টাকার হেরোইন, নগদ টাকা, পুরাতন মডেলের মোবাইল, এমনকি একটি ইলেকট্রিক সিল মেশিনও।
মনে হতে পারে, এসব কোনো সিনেমার দৃশ্য। কিন্তু না এটি বাস্তব। ১১ জন কর্মকর্তা এবং ২৪ সেনাসদস্যের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ টিম এমন নিখুঁত পরিকল্পনার সঙ্গে অভিযান চালিয়েছে, যেন আগে থেকেই তারেকের প্রতিটি চালচলন বিশ্লেষণ করা ছিল।
তারেক হোসেনের বয়স ৩৬। একজন ব্যবসায়ীর ছদ্মাবরণে তিনি বছরের পর বছর ধরে সীমান্তপথে হেরোইন পাচার করতেন বলে দাবি করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তিনি নিজ গ্রামে দোতলা বাড়ি, একটি মার্কেট, গাড়ি, জমি সবই গড়ে তুলেছেন মাদকের অর্থে। তার ব্যবসা ছিল নিখুঁত সংগঠিত, প্রযুক্তি নির্ভর এবং স্থানীয় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দেওয়ার মতো চতুর।
স্থানীয় এক দোকানদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারেক ভাই ভালো মানুষ ছিলেন, আমাদের সাহায্য করতেন। কিন্তু ভেতরে কী চলত, কেউ জানত না। এখন সব পরিষ্কার।
প্রেস ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. গোলাম আজম জানান, তারেক হোসেন শুধু একজন ব্যক্তি নন, বরং একটি সুসংগঠিত মাদকচক্রের নেতৃত্ব দিতেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরও কয়েকজন হোতার নাম পাওয়া গেছে। তাদের ধরতে অভিযান প্রস্তুত রয়েছে।
এই নেটওয়ার্ক কেবল রাজশাহী নয়, পুরো উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় বিস্তৃত ছিল বলে ধারণা করছে ডিএনসি। বিশেষ করে ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে মাদক প্রবেশের নানা রুট নিয়ে এখন তদন্ত চলছে।
ডিএনসির উপপরিচালক মোহা: জিললুর রহমান বলেন, “সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী মাদক নির্মূলে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি। তারেকের মতো চক্রভুক্ত মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে আমরা আরও শক্তভাবে ব্যবস্থা নেব।”
মাদকের বিরুদ্ধে এই ধরপাকড় যেন এক ধরনের বার্তা মাদক যতই শক্তিশালী হোক, আইনের হাত তার চেয়ে শক্তিশালী।
তারেক হোসেন গ্রামে একজন বিত্তবান হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। স্কুলে দান, মসজিদে অনুদান সবকিছুই চলত। অনেকে সন্দেহ করলেও নিশ্চিত ছিলেন না। এখন তার গ্রেপ্তারের পর পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে চাঞ্চল্য। স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষক বলেন, “আমরা ভাবতেই পারিনি এই গ্রামে এত বড় মাদক সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে। এটা আমাদের জন্য বড় শিক্ষা।”
অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন বিশেষ করে তরুণ সমাজ। কারণ, গ্রামে মাদকাসক্তির হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গিয়েছিল।
এই ঘটনা শুধু একজন অপরাধী ধরা পড়ার খবর নয়, বরং সমাজের গভীরে গেঁথে থাকা মাদকের শেকড়ের এক খণ্ড চিত্র। রাজশাহীর মতো এলাকায় যেখানে সীমান্ত খুব কাছাকাছি, সেখানে প্রশাসনের কার্যকর নজরদারি ছাড়া এই চক্রগুলো থামানো কঠিন।
ডিএনসি জানায়, তারেক হোসেনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। একই সঙ্গে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সম্পদ ও অন্যান্য লেনদেন তদন্তাধীন রয়েছে।
তারেক হোসেনের গ্রেপ্তার রাজশাহীতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি প্রশাসনের জন্য যেমন বড় সাফল্য, তেমনি সমাজের জন্য একটি জাগরণের মুহূর্ত। মাদক দমনে ‘জিরো টলারেন্স’ যদি শুধু কথায় না থেকে বাস্তবে পরিণত হয়, তবে হয়তো ভবিষ্যতের তরুণরা পাবে একটি নিরাপদ, মাদকমুক্ত সমাজ।
রাজশাহী আজ একটু বেশি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। কিন্তু এই লড়াই এখনো শেষ হয়নি। এখন শুরু হয়েছে নতুন এক যুদ্ধ নির্বিচারে ও নিঃশেষে মাদক নির্মূলের যুদ্ধ।
এসআর