চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটারব্যাপী নির্মাণাধীন শহীদ ওয়াসিম আকরাম এক্সপ্রেসওয়ে এখন উন্নয়ন, আয়বর্ধন ও নগর সৌন্দর্যের নতুন প্রতিযোগিতার মঞ্চে পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) পাঁচ ঠিকাদার এক্সপ্রেসওয়ের নিচের সড়কে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ পেতে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছেন। তবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) থেকে প্রকল্পটি এখনো সিটি কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে না দেয়ায়, সেই আবেদনের কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রয়েছে বলে জানিয়েছেন চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
ইতোমধ্যে এক্সপ্রেসওয়ের নিচের কিছু অংশে সবুজায়ন, ফুলের বাগান এবং সচেতনামূলক বার্তা প্রচারের জন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছে সিডিএ। ওই ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটি নগরের পরিবেশ সংরক্ষণ ও স্থাপত্যবিধি সম্পর্কিত বার্তা প্রচার করছে। তবে একই স্থানে চসিকের নতুন বরাদ্দের আবেদনকে ঘিরে এখন শুরু হয়েছে আলোচনা, প্রশাসনিক জটিলতা এবং সমন্বয়হীনতার প্রশ্ন।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, এক্সপ্রেসওয়ের নিচের সড়কটি কয়েকটি অংশে ভাগ করে সৌন্দর্যবর্ধনের আবেদন জমা দিয়েছেন পাঁচ ঠিকাদার। লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত বিভিন্ন অংশে আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে লালখান বাজার থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চেয়েছেন মো. আবুল কালামের মালিকানাধীন মেসার্স চ্যাম্পিয়ন এন্টারপ্রাইজ। দেওয়ানহাট থেকে চৌমুহনী মোড় পর্যন্ত অংশের জন্য আবেদন করেছেন নিহার সুলতানার প্রতিষ্ঠান জেএম পাবলিসিটি, যিনি চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সাবেক এক সভাপতির স্ত্রী।
চৌমুহনী মোড় থেকে বাদামতলী মোড় পর্যন্ত এবং বারিক বিল্ডিং থেকে নিমতলা মোড়ের আগ পর্যন্ত কাজের দায়িত্ব নিতে আবেদন করেছে মো. ফজলুল করিমের প্রতিষ্ঠান এফকে ক্লাসিকেল এডভার্টাইজিং। অন্যদিকে আগ্রাবাদ সোনালী ব্যাংক থেকে আগ্রাবাদ টিএন্ডটি ভবনের আগ পর্যন্ত এবং নিমতলা বিশ্বরোড হতে কাস্টম মোড় পর্যন্ত সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য আবেদন করেছে মো. হাসানের মালিকানাধীন এস এন এডভার্টাইজিং। এছাড়া আগ্রাবাদ টিএন্ডটি ভবন থেকে বারিক বিল্ডিং মোড়, ইপিজেড সিমেন্স হোস্টেল থেকে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত অংশের জন্য আবেদন করেছে শারমিন আক্তারের প্রতিষ্ঠান রেড এন্ড ব্ল্যাক, যিনি আব্দুল মালেকের স্ত্রী।
তবে সিটি কর্পোরেশনের এই আগ্রহের বিপরীতে সিডিএ জানিয়েছে, প্রকল্পটি এখনো তাদের আওতায় রয়েছে। সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিম সময়ের কন্ঠস্বর-কে বলেন, ‘আমরা একটি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। তারা সেখানে বাগান করবে এবং কিছু সচেতনামূলক বার্তা প্রচার করবে। যেমন–ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন বা নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কিত তথ্য। তবে কোনো বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন সেখানে প্রদর্শনের সুযোগ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দ বিষয়টি আমাদের জানা নেই। একই স্থানে দুটি প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ নিতে পারে না। আমি প্রয়োজনে মেয়র সাহেবের সঙ্গে কথা বলব। আমাদের মধ্যে আগে থেকেই সমন্বয় রয়েছে; প্রয়োজনে বিষয়টি নিয়েও আলোচনায় বসব।’
এদিকে এক্সপ্রেসওয়ের ওপরের অংশে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন স্থাপনের অনুমতি দেয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন সিডিএ চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়ে এখনো নির্মাণাধীন প্রকল্প। এখানে আমাদের ৫০০ কোটিরও বেশি টাকার ঋণ রয়েছে এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও বিপুল। অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এক্সপ্রেসওয়ের ওপর বিজ্ঞাপন স্থাপনের আবেদন করেছে, কিন্তু আমরা নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বিবেচনা করে সেই অনুমতি দিচ্ছি না।’
অন্যদিকে চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘সিডিএ আমাদের যেসব ফ্লাইওভার বুঝিয়ে দিয়েছে, সেগুলোতে আমরা সৌন্দর্যবর্ধন ও আয়বর্ধক প্রকল্প পরিচালনা করছি। কিন্তু শহীদ ওয়াসিম আকরাম এক্সপ্রেসওয়ে এখনো আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। সিডিএ আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝিয়ে দিলে তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেব। এর আগে সেখানে কোনো উদ্যোগ নেয়া হবে না।’
মেয়রের এই মন্তব্যে পরিষ্কার ইঙ্গিত মিলেছে যে, সিটি কর্পোরেশন এক্সপ্রেসওয়ের নিচের সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পে আগ্রহী হলেও সিডিএর অনুমতি ছাড়া কার্যক্রম শুরু করতে পারবে না।
নগরবাসীর অনেকের মতে, ওয়াসিম আকরাম এক্সপ্রেসওয়ে কেবল একটি পরিবহন অবকাঠামো নয়, এটি চট্টগ্রামের আধুনিক নগরায়ণের প্রতীক হতে পারে। এই সড়কের নিচে সবুজ গাছপালা, আলো, ছায়া, এবং পরিচ্ছন্ন নগরচিত্র গড়ে উঠলে চট্টগ্রাম পাবে এক নতুন সৌন্দর্যের রূপ। তবে সেই সৌন্দর্য বাস্তবায়নের পথে সমন্বয়হীনতা যেন নতুন প্রতিবন্ধকতায় পরিণত না হয়–এমন প্রত্যাশাই এখন সাধারণ নাগরিকদের।
এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি সিডিএর তত্ত্বাবধানে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এটি পুরোপুরি চালু হলে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত যাতায়াতে সময় লাগবে মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিট। প্রকল্পের নিচের সড়ক ও আশপাশের এলাকা যদি পরিকল্পিতভাবে সৌন্দর্যবর্ধনের আওতায় আনা যায়, তবে এটি চট্টগ্রামের অর্থনীতি ও পর্যটন খাতের জন্যও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
এসআর