মুন্সিগঞ্জে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরোধিতা, কোচিং বানিজ্য, মেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনৈতিক আচরণসহ নানামুখী দুর্নীতিতে অভিযুক্ত আলবার্ট ভিক্টোরিয়া যতীন্দ্র মোহন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের(এভিজেএম) শিক্ষক মনোরঞ্জন সূত্র ধরের শাস্তি ও দ্রুত বদলির দাবি তুলেছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। মনোরঞ্জনের বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করে চলেছেন ভুক্তভোগীরা।
নানা মুখী চাপে বিদ্যালয় থেকে মনোরঞ্জনকে সরানো হলেও কাগজে কলমে এখনো বদলি করা হয়নি। তবে মনোরঞ্জন আত্মগোপনে থাকে বিদ্যালয়ে। এতে চরম আবারো ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, ২০১৭ সালে ভৌতবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে এভিজেএম সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে যোগদান করেন মনোরঞ্জন সুত্রধর।শিক্ষকতার সুযোগে শহরের কোটগাঁও এলাকায় তার ভাড়া বাড়িতে বিজ্ঞান অনুশীলন কেন্দ্র নামে একটি কোচিং খুলে ব্যবসা শুরু করেন। ওই কোচিংয়ে শিক্ষার্থীদের পড়তে হুমকি দেওয়া হত। না পড়লে অথবা একবার পরে সেখান থেকে চলে আসলে তাদের সঙ্গে ক্লাসে খারাপ আচরণ করতো। এমনকি পরিক্ষায় ফেল করানো হত। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের শরীরেও অনৈতিকভাবে হাত দিতেন তিনি।
এছাড়াও ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী জেলা শহরের কাজী কমর উদ্দিন সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের দু'জন শিক্ষার্থীর সাথে পরীক্ষার হলে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। করতেন প্রশ্ন ফাঁসের বানিজ্যও। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালে জেলা প্রশাসকের বরাবর মনোরঞ্জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে লিখিত অভিযোগ দেন শিক্ষার্থীরা। তবে সাবেক সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসের আস্থাভাজন হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো শিক্ষার্থীদের পক্ষে থাকা এক শিক্ষককে বিদ্যালয় থেকে বদলি করা হয়।
বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, মনোরঞ্জন স্যার কোচিং ব্যবসা করতেন।তার কাছে পড়তে না গেলে তাদের হুমকি দিতেন। পরিক্ষায় নাম্বার কমিয়ে ফেল করে দিতেন। তাদের শরীরে ব্যাডটার্চ করতেন। এরপরেও অদৃশ্য শক্তির কারনে তিনি এ বিদ্যালয়ে বহাল তবিয়তে ছিলেন। জুলাই-আগস্ট মাসে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছিল। ৪ আগস্ট আরো বেশি আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। যারা আন্দোলনে গিয়েছিল, যাদের যাওয়ার কথা ছিল, সবার তথ্য সংগ্রহ করে আ.লীগের নেতাদের লোকজনের কাছে দেয় তিনি। এজন্য ৪ আগস্ট শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধরতে আ.লীগের লোকজন অভিযান চালায়।
এমন পরিস্থিতে বিদ্যালয়টির বর্তমানে কর্মরত ৩৪ জন শিক্ষকের মধ্যে ৩০ জনই গত ৩ সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে মনোরঞ্জনের অপেশাদার আচরণ ও তার দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে তাদের স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগ জমা দেন।
এছাড়াও, গত ৫ সেপ্টেম্বর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বর্তমান শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকসহ অন্তত চার শতাধিক ব্যক্তির গণস্বাক্ষরে আরো একটি স্বারকলিপি জেলা প্রশাসককে দেওয়া হয়।
সেদিনই মনোরঞ্জনের বরখাস্তের আহ্বান জানান শিক্ষার্থীরা। এ সময় অভিযুক্ত মনোরঞ্জন সূত্রধর সকলের উপস্থিতিতে আবেদনে স্বাক্ষর করেন। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত উত্তপ্ত ছিল বিদ্যালয়ের পরিস্থিতি। পরে সেনাবাহিনী ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় বিদ্যালয় ত্যাগ করেন মনোরঞ্জন।
মনোরঞ্জন একজন শিক্ষক হলেও তিনি ফ্যাসিস্টের দোষর, তিনি নিজেও ফ্যাসিস্ট ছিলেন বলে দাবি করে তার বদলিসহ সর্বচ্চো ব্যবস্থা চান বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নূরে আলম বলেন, ৪-৫ বছর ধরেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রায় সময়ই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ্য করে শিক্ষার্থীরা জেলা প্রশাসক বরাবর একটি অভিযোগ পত্র দাখিল করে। তার একটি অনুলিপি আমাকে দেওয়া হয়েছে। তার স্বাক্ষরিত বদলির আবেদনটি জেলা প্রশাসন হয়ে এখন বোর্ডে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলা এড়াতে পরবর্তী আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত তিনি ছুটিতে আছেন বলেও জানান প্রধান শিক্ষক।
এদিকে, মনোরঞ্জ বিদ্যালয়ে না আসলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে, বিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে তার চক্রান্ত চলছেই। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের মনগড়া অসত্য তথ্য প্রকাশ করেছেন। যা বিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট করছে বলে অভিযোগ করেন বিদ্যালয়টির শিক্ষক আরিফ, রাসেল, গফুর, মাহফুজ সহ আরো অনেকে। একই সাথে ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন বলেও জানান এই শিক্ষকরা।
এ ব্যাপারে শিক্ষক মো. আব্দুল গফুর সরকার বলেন, প্রায় ৭ বছর যাবৎ অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সাথে শিক্ষকতা করে আসছি। বিদ্যালয়টি ২ শিফটের এবং আমি প্রভাতি শাখায় ও মনোরঞ্জন স্যার দিবা শাখায়। ভিন্ন বিষয়ের হওয়ায় বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন ও বিদ্যালয়ের মিটিং ছাড়া আমাদের দেখা হওয়ার কোন সুযোগ নেই। উনার সাথে আমার ব্যক্তিগত বা পেশাগত কোন বিরোধও নেই। আমার নামে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।
আরিফ হোসেন নামের অপর একজন শিক্ষক বলেন, আমার সাথে মনোরঞ্জন স্যারের ব্যাক্তিগত কোন দ্বন্দ্ব নেই। তার বিরুদ্ধে ডিসি অফিস ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিদ্যালয়ের ৩৪ জন শিক্ষকের মধ্যে দুজন হিন্দু শিক্ষক সহ ৩০ জন শিক্ষক ২১ পৃষ্ঠার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এখানে কেউ ব্যাক্তিগতভাবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে নি বরং সামষ্টিকভাবে। তাই, ৩০ জন শিক্ষকের নাম উল্লেখ না করে অল্প কয়েকজন শিক্ষকের নাম জড়ানো স্পষ্টত উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. রিফাত ফেরদৌস বলেন,আপনারা জানেন সরকারি কোন শিক্ষককে আমরা অপশারন করতে পারি না, তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর আমাদের যা কার্যক্রম করা দরকার ছিল আমরা সেগুলো করেছি। যেমন তাকে অপশারনের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর মাউশিতে অভিযোগপত্র পাঠিয়েছি, তারা ব্যবস্থা নিলেই আমরা সেগুলো বাস্তবায়ন করব।
এমআর