কলকাতায় শহরে ইঁদুরের তাণ্ডব। বাসাবাড়ি, ফুটপাত, উড়ালসেতুর ভিত সর্বত্রই ইঁদুরের দাপাদাপি। এমনকি শ্মশানেও সরব তারা। ইঁদুরের এমন উৎপাতে বিরক্ত নগর মেয়র। পুরসভার মাসিক অধিবেশনে মেয়র কাছে আরজি জানিয়েছেন এক কাউন্সিলরও। প্রশ্ন উঠছে, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সন্ধান কলকাতায় বসে মিলবে কি?
শুক্রবার কলকাতা পুরসভার মাসিক অধিবেশনে উঠে আসে ইঁদুরের যন্ত্রণার কথা। পুরসভার ১২১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কংগ্রেস কাউন্সিলর রূপক গঙ্গোপাধ্যায় মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে প্রত্যেক দিন ইঁদুরের সংখ্যা বাড়ছে। মাননীয় মহানাগরিক, আমার ওয়ার্ডকে ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা করুন।’
অবশ্য ইঁদুরের উৎপাত কলকাতা শহরে নতুন নয়। ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক তারের লাইন, কংক্রিটের উড়ালপুলের ভিত খুঁড়ে ফেলেছে ইঁদুর। কলকাতার বস্তি এলাকা থেকে শুরু করে হেরিটেজ তকমা পাওয়া ভবন সর্বত্রই ইঁদুরের দাপাদাপি। একসময় ইঁদুরের জন্য ঢাকুরিয়া ব্রিজ বিপন্ন হয়েছিল।
কলকাতা পুরসভার তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়া এবং ভবানীপুরের বস্তি অঞ্চলগুলো ইঁদুরের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।সপ্তাহখানেক আগে ইঁদুরের উপদ্রবে কলকাতার শ্মশানে মৃতদেহ সৎকারে বাধা সৃষ্টি হয়েছিল। কাশিপুর মহাশ্মশানে ইলেকট্রিক চুল্লির তার কেটে দিয়েছিল ইঁদুর। বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিন্ন হওয়ায় সেখানে দিনের পর দিন সৎকারে সমস্যা দেখা দেয়।
তার আগে ‘টক টু মেয়র' অনুষ্ঠানে ফিরহাদ হাকিম বলেছিলেন, ‘কীভাবে ইঁদুর বাস করছে তা আগামী দিনে বোঝা যাবে। সুরাট শহর একটা সময় প্লেগে ছেয়ে গিয়েছিল। এখন থেকে সতর্ক না হলে, ভবিষ্যতে মহামারি হতে পারে কলকাতায়।’
কলকাতায় বড় বড় সৌধ, সেতু, পুরভবন ইঁদুরের আক্রমণে ধসের মুখে পড়েছে। তা থেকে ঐতিহ্যবাহী বড় বড় বাড়িও রেহাই পায়নি। ইঁদুর মাটি আলগা করে দিচ্ছে। যার ফলে শহরে বড় বড় গাছ পড়ে যাচ্ছে।
কলকাতা পুরনিগমের অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট অনুযায়ী, শহরে ফুটপাতের ৬০- ৬২ শতাংশের অবস্থা খারাপ। এর জন্য ভূগর্ভে ইঁদুরের তাণ্ডবকে দায়ী করা হয়েছে।
মেয়র ফিরহাদ হাকিম খাদ্য ব্যবসায়ীদের কাছে আবেদন করেছিলেন যেন হোটেলের আবর্জনা, বাসি খাবার রাস্তার ধারে না ফেলা হয়। এই আবর্জনাগুলো থেকে এই ইঁদুরের উৎপাত বাড়ছে।
পার্কস্টিট, মানিকতলা, হাজরা, বড়বাজার, হাতিবাগান এলাকায় স্ট্রিট ফুডের দোকান রয়েছে অজস্র। এখানে ফুটপাত তৈরির তিন চার মাসের মধ্যেই গর্ত হয়ে যাচ্ছে। পুরনিগমের সড়ক বিভাগের ইঞ্জিনিয়াররা তাতেই পড়েছেন উদ্বেগে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফুটপাত তৈরি করার পরও ইঁদুরের তাণ্ডবে তা নষ্ট হচ্ছে।
কেন উৎপাত করছে ইঁদুর?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নগরায়ন বাড়তে থাকায় ইঁদুরের স্বাভাবিক বাসস্থান নষ্ট হচ্ছে। নিজেদের আবাস হারিয়ে নতুন আবাসের সন্ধানে ইঁদুরেরা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস বলেন, ‘শহরের বাস্তুতন্ত্রের অংশ হিসেবে ইঁদুর নিশ্চয়ই পড়ে। নগরায়নের উত্তরোত্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইঁদুরদের স্বাভাবিক বাসস্থানগুলো অর্থাৎ পার্ক, উদ্যান, জলাশয়ের ধারের জায়গা ইত্যাদি ক্রমশ নির্মাণে ভরে যাচ্ছে। ফলে ইঁদুররা যেসব জায়গায় থাকতো, সে সব জায়গা থেকে তাদের বাস্তুচ্যুতি ঘটছে৷ তাই তারা নতুন বাসস্থান খুঁজছে। কখনো রাস্তা বা সেতুর অগভীর ভিত্তিতে ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করছে।’
এদিকে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণীচিকিৎসা বিজ্ঞান ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিদ্ধার্থ জোয়ারদার বলেন, ‘কলকাতা এবং হাওড়া সংলগ্ন শহরতলিতে বর্তমান সময়ে ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও এর সাথে ইঁদুরের খাবারের পর্যাপ্ত সরবরাহ। অন্যদিকে প্রকৃতির রোষানলে তাদের না পড়া। প্লেগ, লেপ্টোস্পাইরোসিসের মতো মহামারি শহরে না হওয়ায়, এরা নিশ্চিন্তে সংখ্যায় বেড়েছে।
সম্প্রতি কলকাতাকে জঞ্জালের শহর বলে মন্তব্য করেছেন তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী রেভন্ত রেড্ডি। অবশ্য কলকাতার রাস্তাঘাটে জমে থাকা আবর্জনা নিয়ে পরিবেশকর্মীরা চিন্তিত। আর অপরিকল্পিতভাবে জঞ্জালব্যবস্থাপনার কারণে বাড়ছে উঁদুরের উৎপাত- এমনটাই জানালেন পরিবেশকর্মী নব দত্ত৷
তিনি বলেন, ‘কলকাতায় এই দশকের এত খারাপ আবর্জনা ব্যবস্থাপনা অতীতে কোন সময় আমরা দেখিনি। পুরো শহরটা একটা জঞ্জাল নগরীতে পরিণত হয়েছে।
নব দত্তের মতে, ‘কোথাও জঞ্জাল ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না, ইচ্ছামতো জঞ্জাল জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তার ধারের ফুড হকাররা বেআইনি জিনিসপত্র যেমন থার্মোকল, সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ইত্যাদি ব্যবহার করছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গাফিলতির জন্যই ভেক্টর বোর্ন ডিজিজ বাড়ছে। একটার সঙ্গে আর একটা সম্পর্কিত।’
সূত্র: ডয়েচে ভেলে
এফএস