চট্টগ্রামে লুট হওয়া অস্ত্র চোরাচালান চক্রের মূলহোতা হিসেবে পুলিশ কনস্টেবল মো. রিয়াদসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দীর্ঘ অনুসন্ধান ও গোয়েন্দা নজরদারির পর নগরীর পতেঙ্গা ও বাকলিয়া এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও সাত রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়, যা পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে লুট হওয়া বলে প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন, বিক্ষুব্ধ জনতা নগরীর বিভিন্ন থানায় হামলা চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি লুট করে। ওই সময় চট্টগ্রামের আটটি থানা ও আটটি ফাঁড়ি থেকে ৮১৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৪৪,৩২৪টি গুলি লুট হয়। তদন্তে উঠে আসে, লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর একটি অংশ অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায় এবং তা বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়।
গ্রেপ্তার হওয়া পুলিশ কনস্টেবল মো. রিয়াদ চাঁদপুর জেলা পুলিশে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায়। অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লোহাগাড়া থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রগুলো বিক্রির পরিকল্পনা করেন তিনি। তাকে সহায়তা করেন তার পাঁচ সহযোগী— আবদুল গণি, আবু বক্কর, ফরহাদ হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান ও মো. ইসহাক।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজ উদ্দিন সময়ের কণ্ঠস্বর-কে জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কনস্টেবল রিয়াদ, আবু বক্কর ও মোস্তাফিজুর রহমান আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বাকি দুই আসামির তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
গত ৩ মার্চ, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার এওচিয়া ইউনিয়নে ডাকাত সন্দেহে উত্তেজিত জনতার গণপিটুনিতে জামায়াত কর্মী নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেক নিহত হন। পরে নেজাম উদ্দিনের মরদেহের পাশে একটি পিস্তল পাওয়া যায়। তদন্তে বেরিয়ে আসে, এই অস্ত্রটি ছিল কনস্টেবল রিয়াদের মাধ্যমে বিক্রি হওয়া লুটের অস্ত্রগুলোর একটি।
নেজামের মরদেহের পাশ থেকে পিস্তলটি উদ্ধারের পর ৬ মার্চ সাতকানিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হাসান দায়ের করা মামলায় মোট ছয়জনকে আসামি করা হয়। আসামিরা হলেন—আলমগীর (২০), পিতা: কবির আহাম্মদ, কাঞ্চনা ইউনিয়ন, ১ নম্বর ওয়ার্ড, ফরহাদ (৪০), পিতা: আব্দুস সাত্তার, ৬ নম্বর ওয়ার্ড, ফারুক ওরফে কালা ফারুক, পিতা: আলমগীর, ৮ নম্বর ওয়ার্ড, সাইফুদ্দীন ওরফে সাবু, পিতা: গুরা মিয়া, উত্তর কাঞ্চনা দীঘির পাড়, এবং হারুন (সিএনজি চালক), পিতা: আব্বাস উদ্দিন, চুড়ামণি, এওচিয়া ইউনিয়ন। এছাড়া ১৪-১৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার তদন্ত টিম রিয়াদকে আটক করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ চালায়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন, লোহাগাড়া থানার লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর একটি অংশ পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পতেঙ্গার কাঠগড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরও একটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) রাতে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের ঘটনায় চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আফতাব হোসেন বাদী হয়ে পতেঙ্গা থানায় মামলা করেন।
শুক্রবার (২১ মার্চ) বিকেলে গ্রেপ্তার ছয়জনকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু বক্কর সিদ্দিকের আদালতে নেওয়া হয়। সেখানে কনস্টেবল রিয়াদ, আবু বক্কর ও মোস্তাফিজুর রহমান অস্ত্র কেনাবেচায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। তবে ইসহাক জবানবন্দি দেননি। অন্যদিকে, আবদুল গণি ও ফরহাদ হোসেনকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ জানিয়েছে, এই অস্ত্র চোরাচালান চক্রের পেছনে আরও কেউ জড়িত আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং দোষীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে পুলিশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ৫ আগস্টের মতো ভয়াবহ ঘটনার পরও যদি লুট হওয়া অস্ত্র পুনরুদ্ধার করা না যায় এবং তা অপরাধীদের হাতে চলে যায়, তাহলে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর বড় ধরনের আঘাত আসতে পারে। সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত দ্রুততম সময়ে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করা এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।