রহমত,মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে আসে পবিত্র রমজান। এটি আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের মাস,যা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অনন্য নিয়ামত। রমজানের আগমনে সবার মধ্যে তৈরি হয় নতুন এক আমেজ। রমজান মাস মানেই পরিবারের সঙ্গে ইফতার,সেহরি আর আত্মীয়-স্বজনের সান্নিধ্যে থাকা।
কিন্তু টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রোজার আগেই সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হওয়ায় এই সময়টায় তারা পরিবার থেকে দূরে,হলে বা মেসে অবস্থান করছেন।রমজান চলমান থাকলেও এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি হয়নি,তাই বাসার বাইরে থেকেই কাটছে শিক্ষার্থীদের রমজানের দিনগুলো। অনেকের জীবনে পরিবার ছাড়া এটিই প্রথম রমজান। বন্ধু ও সহপাঠীদের সঙ্গে ইফতার করতে আনন্দ থাকলেও অনেকের মনে কষ্টও রয়েছে। পরিবারের সঙ্গে ইফতার বা সেহরিতে অংশ নিতে না পারায় তারা নিজেদের অনুভূতির কথা জানিয়েছেন।এ সময় পরিবার থেকে দূরে অবস্থান করে সিয়াম পালনের নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা ও চ্যালেঞ্জের কথা ব্যক্ত করছেন টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী।এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা হয় ‘সময়ের কন্ঠস্বরে’র ক্যাম্পাস প্রতিনিধির।
ক্যাম্পাস রমজানের শুরুর দিনগুলোতে খোলা থাকায় পরিবারের সঙ্গে ইফতার আর সাহরী করতে না পারার একটা দুঃখ মনের মধ্যে থেকে গেলেও, ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সঙ্গে ইফতারের মুহূর্তগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে অশেষ ভালোবাসা আর আবেগ।এই রমজানে ক্যাম্পাসে কেমন কাটছে জানতে চাইলে বিএমবি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আরজিনা আক্তার নিপা জানান-“এই প্রথম বাড়ি থেকে দূরে ইফতার,সাহরি করছি।প্রথমবার রমজানে পরিবারের বাইরে ক্যাম্পাসে থাকার অভিজ্ঞতা অনেকটা মিশ্র অনুভূতির।একদিকে স্বাধীনতা,নতুন অভিজ্ঞতা আর বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর আনন্দ।অন্যদিকে পরিবারের জন্য একটা গভীর মিসিং,কি যেনো নাই"
তিনি আরও বলেন, "ইফতারের সময়টা সবচেয়ে বেশি মনে হয় বাসার কথা।মায়ের স্পর্শ ছাড়া প্রতিটি খাবার।প্রতিটি মুহূর্ত।স্পেশ্যালি মায়ের হাতের রান্না,ভাইবোনদের সঙ্গে ইফতার প্লেট নিয়ে ঝগড়া,বাবার সেই দোয়ার মাহফিল,জিলাপি দিয়ে মুড়িমাখা- সেই ঘরোয়া উষ্ণতা, রমজানের আমেজ টা এবার পাইনি!এসব ভীষণ মনে পড়ে।কতদিন ইফতার নিয়ে ই কান্না করে দিয়েছি।কিন্তু এবার সব কিছুর বাইরে নতুন অভিজ্ঞতা ও হয়েছে।রুমমেট এর সঙ্গে একসাথে সাহরি খাওয়া,তারাবি পড়া— হুট করে বন্ধুদের সাথে ইফতার।কোনদিন ডিপার্টমেন্টে বা কোনোদিন ক্লাবে।আর গতকাল তো এসোসিয়েশন এর ইফতারের আয়োজন করা হলো।পরিবার না পেয়েও যেনো নতুন পরিবারের সাথে নতুন অভিজ্ঞতা। পরিবার নিয়ে খারাপ লাগা থাকলেও এসব এ এত এত ভাললাগা নিহিত ছিল।তবে রাত জেগে পড়াশোনা আর সাহরির পর ক্লাস করা,এক্সাম দিতে যাওয়া টা একটু চ্যালেঞ্জিং মনে হয় আমার কাছে। তবুও এই সময়টাতে অনেক কিছু শিখেছি আমি__কীভাবে নিজের দায়িত্ব নিতে হয়, নিজের খেয়াল রাখতে হয় আর পরিবার ছাড়া কেমন করে একা থাকতে হয়”
প্রথম বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী সিপিএস বিভাগের ইমরান হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন- “পরিবার ছাড়া ক্যাম্পাসে প্রথম রমজান কাটানো একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা।ক্যাম্পাসে নতুন নতুন বন্ধুদের সঙ্গে ইফতার ও সেহরি করা একটি বিশেষ আনন্দের অভিজ্ঞতা।ক্যাম্পাসের মসজিদে বন্ধুদের সঙ্গে একত্রে তারাবি নামাজ আদায় আত্মতৃপ্তি দেয়।ক্যাম্পাসের বন্ধুদের সঙ্গে ইফতার পার্টি ও ধর্মীয় আলোচনায় অংশগ্রহণ করে নতুন জ্ঞান অর্জন করা যায়।ক্যাম্পাসে প্রায়ই ইফতারের আয়োজন করা হয়,যেখানে অনেক শিক্ষার্থী অংশ নেন। বন্ধুদের মিলে একসঙ্গে ইফতার করাটা অন্যরকম অনুভূতি দেয়।রমজানে ক্যাম্পাসের পরিবেশ পুরোপুরি বদলে যায়।সবাই নামাজ ও ইবাদতের দিকে মনোযোগী হয়।অন্য রকম আমেজ তৈরি হয়।কিন্তু পরিবারের সঙ্গে ইফতার ও সেহরি করার আনন্দ অনেক মিস করছি।গতবছর রমজান মাস বাবা মা এর সাথে কাটিয়েছিলাম।অনেক ভালো লেগেছিল তখন,সারা দিন রোজা রেখে বাবা মার সাথে ইফতার করা,ইফতার বানাতে মা কে সাহায্য করা,এ যেন অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করতো। ক্যাম্পাসে প্রথম রমজান একটি মিশ্র অভিজ্ঞতার নাম। এখানে যেমন নতুন বন্ধুত্বের সুযোগ রয়েছে,তেমনি পরিবারের অভাবও অনুভূত হতে পারে। তবে,সঠিক পরিকল্পনা ও বন্ধুদের সহযোগিতায় এই সময়টি স্মরণীয় করে রাখা সম্ভব”
সিএসসি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাইমুর রহমান জানান, "একই সাথে ক্লাস,পরীক্ষা,টিউশন থাকায় ক্যাম্পাসে খুব ব্যস্ত সময় পার করছি।এর মধ্যেও পরিবার কে খুব মিস করতেছি,কারণ রমজানে পরিবারের সাথে একসাথে বসে ইফতার করার অনুভূতি অন্যরকম।আর যদি বলি ক্যাম্পাসে তো হলের বন্ধু দের সাথে এক সাথে ইফতার খাওয়া তে ভালো যাচ্ছে। বাড়ি থেকে দুরে আছি রমজানে বাড়ির কথা মনে পরছে”
গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বখতিয়ার হোসেন সিমান্ত রমজান নিয়ে তার অভিব্যক্তি ও কিছু দাবির কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন- “রমজান এলেই ক্যাম্পাসে এক অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি হয়।দিনের বেলা ক্যাফেটেরিয়া ও চায়ের দোকানগুলোতে সুনসান নীরবতা নেমে আসে, কিন্তু বিকেলের দিকে ইফতারকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের ব্যস্ততা চোখে পড়ে।বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে নামাজের জন্য শিক্ষার্থীদের সমাগম বেড়ে যায়,তারাবির নামাজে কাতার দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।বিশেষ করে, ইফতারকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মাঝে একধরনের সৌহার্দ্যপূর্ণ বন্ধন তৈরি হয়।বন্ধুরা একসঙ্গে ইফতার আয়োজন করে,কেউ কেউ দরিদ্রদের মাঝে ইফতার বিতরণে অংশ নেয়। এসব উদ্যোগ শুধু ধর্মীয় দায়িত্ব পালনই নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
সিমান্ত কিছু দাবি করে বলেন- “আবাসিক হলে ইফতারের কোন আয়োজন নেই।হলে হলে ইফতারির আয়োজন চাই।আবার সেহরির মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।সেহেরির রান্না আরও ভালো করতে হবে।আমাদের পরীক্ষার রুটিন হয়ে গেছে,সেই অনুযায়ী পরিক্ষা চলছেই।রমজানে আগেই পরীক্ষা শেষ করলে আমাদের জন্য ভালো হতো।দীর্ঘসময় রোজা রেখে পরীক্ষার চাপ সামলানো আমাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা আশা করি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন আবাসিক হলে ইফতারের ব্যবস্থা করে এবং সেহরির রান্নায় মানোন্নয়ন করে।
ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সাইন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল আলিম জানায়-“মাহে রমজান আসলেই পরিবারের সাথে সময় কাটানোর দিনগুলো মনে পড়ে যায়।সেহেরিতে আম্মু ডেকে দিত। সবাই মিলেমিশে আম্মুর কাজে সহযোগিতা করতাম।। সেহরি খেতে খেতে গল্প করতাম,খুব সুন্দর দিন। ইফতারের সময় সবার ছোটাছুটি। সব মিলিয়ে পরিবারের সাথে ইফতার খুব ভালো কাটত।এখন এখানেও বন্ধু,সিনিয়র জুনিয়রদের সাথে মিলেমিশে হলে ইফতার করছি।পরিবারে শূন্যতা কিছুটা হলেও দূর হয়েছে”
অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া রহমান নিরার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান- "রমজানে পরীক্ষা থাকায় খুব ব্যস্ত সময় পার করছি।শত ব্যস্ততার মধ্যেও পরিবারের কথা মনে পড়ে।সারা দিনের ব্যস্ততা শেষে মেসে বন্ধুদের সাথে ইফতার করতে ভালো লাগা কাজ করে।অনেক সময় কম্পাসে সব বন্ধুদের সঙ্গে ইফতারের আয়োজন করা হয়।সেখানে পরিবারের বাইরেও যেন আরেকটি পরিবার।সবার সাথে মিলে মিশে ইফতার করতে ভালো লাগে।কিন্তু ইফতারে মূল ইনগ্রিডিয়েন্ট হলো আমাদের পরিবার।তাই পরিবারকে খুব মিস করছি"
জননেতা আব্দুল মান্নান হলের আবাসিক ছাত্র অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী উৎস কর্মকার জানান- "রমজান মাসেও আমাদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে আমাদের তেমন সমস্যা হচ্ছে না।খাবার প্রতিদিন হলে রান্না হচ্ছে।আমাদের শুধু বাজার করতে হচ্ছে এই আর কি"
মাস্টার্স শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী হেনামুল হাসান হিমু জানান,"এটিই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শেষ রমজান।আমার জন্য রমজান মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা অনেকটাই ভিন্ন এবং বিশেষ অনুভূতির জন্ম দেয়। বন্ধুদের সঙ্গে ইফতার করা ক্যাম্পাস জীবনের অন্যতম আনন্দদায়ক অংশ।কিছু জায়গায় মসজিদ বা কমন রুমে সম্মিলিত ইফতার হয়,যা সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে।রমজান মাস শুধু আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের মাসই নয়,এটি সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই মাস সমাজে সংহতি,সহমর্মিতা ও মানবিকতা বাড়িয়ে দেয়।ধর্মীয় আলোচনা,দোয়া মাহফিল এবং কোরআন তেলাওয়াতের মতো কার্যক্রম বাড়তে দেখা যায়”
তিনি আরও বলেন “বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়,অনেক ক্ষেত্রে অমুসলিমরাও মুসলিমদের রোজার প্রতি সম্মান দেখায়।রমজান শুধু ব্যক্তিগত ইবাদতের মাস নয়,বরং এটি সামাজিক বন্ধন, সহমর্মিতা ও মানবতার প্রসার ঘটায়। সমাজকে আরও ন্যায়বিচার ও সহানুভূতিশীল হতে সাহায্য করে,যা সারাবছর আমাদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে”
মাস্টার্সের আরেক শিক্ষার্থী সুজন চন্দ্র দাস বলেন, "রমজান মাস সিয়াম সাধনার সময়, এই মাসে আমাদের মুসলিম বন্ধুরা সারাদিন রোজা রেখে সন্ধ্যায় ইফতার করেন। ইফতারের এই আনন্দঘন মুহূর্তে আমাদেরও তারা সাথে রাখেন। সকল ধর্মের মানুষ একত্রে সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। যা পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধকে আরও দৃঢ় করে"
এনআই