৫ আগস্টের পর একমাস ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ থাকলেও সবমহলকে ম্যানেজ করে আবারও ‘চ্যানেল ফাইল’ চালু হয়েছে ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। আর এজন্য প্রতি আবেদন ফাইলে দিতে হয় এক হাজার টাকা। যা অফিস খরচ বাবদ নেওয়া হয় বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
আর এভাবেই প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ শত আবেদন ফাইলে নেওয়া হচ্ছে কয়েক লাখ টাকা। পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট না পেয়ে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা। সব মিলিয়ে পাসপোর্ট অফিসটি এখন ঘুষ ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
অভিযোগ আছে, কম্পিউটার দোকানের ছদ্মবেশী কর্মচারী দালালের মাধ্যমে এই ঘুষ নেন ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক শাহ মুহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ। সপ্তাহে যা টাকা ওঠে, প্রতি বৃহস্পতিবার শতকরা (পার্সেন্টেজ) হিসাবে তা ভাগাভাগি হয়। ভাগের প্রায় ৬০/৭০ শতাংশ পান উপ-পরিচালক শাহ মুহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ। বাকি ৩০/৪০ শতাংশ দালালসহ অফিসের অন্য কর্মচারীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে বদলি হয়ে আসার আগে রংপুর বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে থাকাকালীন ঘুষ বাণিজ্য ও দুর্নীতির ঘটনায় একাধিকবার বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছেন এই কর্মকর্তা।
এক সপ্তাহ সরজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাসপোর্ট অফিসের আশপাশের কম্পিউটার দোকানকে কেন্দ্র করে স্থানীয় দালাল ও কম্পিউটার মালিকদের নিয়ে একটি দালাল সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। পুরো পাসপোর্ট অফিসজুড়ে দালালদের অবাধ চলাফেরা, এমন কি গোপন কক্ষে যেতে লাগে না কারো অনুমতি। কর্মকর্তা থেকে কর্মচারী সকলের কক্ষে অনায়াসে যেতে পারে দালালরা। আর এই দালাল সিন্ডিকেটের সাথে পিয়ন, ঝাড়ুদার ও কর্মচারীসহ পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জামাল উদ্দীন ও উপ-পরিচালক শাহ মুহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ’র গোপন আঁতাত রয়েছে। এর ফলে সহজেই ঘুষের টাকা লেনদেন হয়।
প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ শত পাসপোর্ট আবেদন জমা হয় এই পাসপোর্ট অফিসে। এ আবেদনগুলো কম্পিউটারের দোকান থেকে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। আর এসব আবেদনের প্রিন্ট কপি জমার সময় ‘চ্যানেল ফাইল’ এ একটি সংকেত লিখে দেয় দালাল চক্রের সদস্যরা। আর এতে পাসপোর্ট অফিসের জমা কক্ষে কোন বাধা ছাড়াই ‘চ্যানেল ফাইল’ সহজেই সাবমিট হয়ে যায়। আর কোনো আবেদন সংকেত ছাড়া জমা দিলে তা ভুল আবেদন দেখিয়ে ফেরত দেয়া হয়। এ কক্ষ থেকেই ‘চ্যানেল ফাইল’ এর হিসাব রাখা হয়। পরবর্তীতে ‘চ্যানেল ফাইল’ এর আবেদনগুলির ঘুষের এক হাজার টাকা আদায় করে নেয় নির্ধারিত কর্মচারীরা।
এদিকে সব নিয়ম মেনে পাসপোর্ট আবেদন করে পাসপোর্ট প্রাপ্তির তারিখ অতিবাহিত হলেও পাসপোর্ট পাওয়া যায়না বলে অভিযোগ করেন পাসপোর্ট আবেদনকারীরা। সম্প্রতি, সরকার থেকে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল করা হলেও সেটার জন্য নেয়া হয় টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ঘুষ চ্যানেলে আদায়কৃত বিপুল অঙ্কের অবৈধ অর্থের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পান সংশ্লিষ্ট অফিস প্রধান। বাকি টাকা পিয়ন-দারোয়ান থেকে শুরু করে অফিস স্টাফদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করা হয়। এছাড়া ঘুষের ভাগ পান স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু সদস্য এবং অখ্যাত পত্রিকার সাংবাদিক নামধারী এক শ্রেণির দালাল। তবে এসব ঘুষের কোনো অফিসিয়াল রেকর্ড থাকে না। ঘুষদাতা এবং ঘুষগ্রহীতার স্বার্থ জড়িত থাকায় এ বিষয়ে কেউ সরাসরি মুখ খুলতে রাজি হয়নি। তবে গোপন ক্যামেরায় সব কথোপোকথন রেকর্ড করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, আনসার সদস্য ও দালালের মাধ্যমেই পাসপোর্ট করতে আসা লোকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন অফিসের কর্তারাই। প্রত্যেক আনসার সদস্য বা দালালের আলাদা কোড নম্বর রয়েছে। ফলে আবেদন জমা হলেই অফিস কর্তারা বুঝতে পারেন, আবেদনটি কোন দালাল বা আনসার সদস্যের মাধ্যমে জমা হয়েছে। কৌশল করে আনসার সদস্য এমনকি দালালরা আবেদনকারীকে দিয়ে সরকারি ফি ব্যাংকে জমা করায়।
সেবাগ্রহীতার মধ্যে অনেকেই জানান, ঘুষ না দিলেই পাসপোর্টের আবেদন হয়ে যায় ত্রুটিপূর্ণ। দালালচক্রের মাধ্যমে আনসার সদস্য ধরে ঘুষ দিলে ত্রুটি থাকলেও বিশেষ সংকেতে গ্রহণ করা হয় আবেদন। এভাবে চক্রটি প্রতি মাসে কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে বলে তথ্য রয়েছে।
আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রাপ্ততথ্যে জানা গেছে, প্রত্যেক নাগরিককে অনলাইনে আবেদনের ক্ষেত্রে ৪৮ পৃষ্ঠার এবং পাঁচ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৪ হাজার ২৫ টাকা (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাটসহ) ফি জমা দিতে হবে। এই পাসপোর্ট পেতে ১৫ থেকে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হবে। আর জরুরি পাসপোর্ট করতে লাগবে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, আর এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৭ থেকে ১০ দিন। অন্যদিকে ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে অতীব জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা।
এছাড়া ৪৮ পৃষ্ঠার এবং দশ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা লাগবে। এই পাসপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৫ থেকে ২১ দিন। আর ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে ফি দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এর বাইরে অতীব জরুরি পাসপোর্ট ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে নিতে চাইলে শুধু ফি গুনতে হবে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা।
এছাড়া সরকারি চাকরিজীবী যাদের এনওসি, অবসর সনদ (পিআরএল) রয়েছে তারা নিয়মিত ফি জমা দেওয়া সাপেক্ষে জরুরি সুবিধা/জরুরি ফি জমা দেওয়া সাপেক্ষে অতীব জরুরি সুবিধা পাবেন। পাসপোর্ট নবায়নের ক্ষেত্রে সমপরিমাণ ব্যাংক চালান প্রযোজ্য হবে।
এদিকে নির্ধারিত ফি ছাড়াও অনলাইন ফি বাবদ ২০০ থেকে ৩০০ টাকা এবং পাসপোর্টের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করতে পাসপোর্ট অফিসের পাশের দোকানগুলোতে অতিরিক্ত আরও ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। আবার কেউ কেউ না বুঝে চক্রের ফাঁদে পড়ে এর চেয়েও বেশি টাকা দিয়ে থাকেন। অভিযোগের সুরে এমনটাই জানিয়েছেন ফুলবাড়ীয়া উপজেলা থেকে আসা নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী।
শুধু কম্পিউটারের দোকান বা অনলাইন সার্ভিস নেওয়ার ক্ষেত্রেই বাড়তি টাকা গুনতে হয় না। টাকা দিলে পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তি কমবে এমন আশ্বাস দিয়ে কাজ করে দেন সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরাও। তবে এ ক্ষেত্রে সহজ-সরল ও গ্রাম থেকে আসা মানুষজনই সবচেয়ে বেশি তাদের টার্গেটের শিকার হয়ে থাকেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জামাল উদ্দীন বলেন, চ্যানেল ফাইল সম্পর্কে সবাই জানে, এটা তো ওপেন সিক্রেট, যা ভেতরে-বাইরে সকলেই জানে। আর আমার বিষয়ে কেউ খারাপ মন্তব্য করতে পারবে না, যদি কেউ করে তাকে ধরে নিয়ে আসবো।
এদিকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, ২৪-শের জুলাই-আগস্ট দেশে ছাত্র-জনতা যে স্পিরিট বুকে ধারণ করে কঠোর আন্দোলন-সংগ্রাম করে গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল সে স্পিরিট ধারণ করে না তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, জুলাই স্পিরিট, ৫ আগস্ট বুঝিনা, আমরা আমাদের কাজ করছি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ময়মসসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক শাহ মুহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ’র মুখোমুখী হলে তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন, এটা কোন পীরের দরবার নয়, যে সবাই সৎ হবে। সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ থাকলে, অভিযোগ আকারে আমার কাছে দেন, আমি দেখবো। আর মানুষ সচেতন না হলে দালালরা সুবিধা নিবেই, তাই মানুষকে আগে সচেতন হতে হবে। আমার অফিসে কোন ঘুষ বাণিজ্য হয়না, যেকেউ সরাসরি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারে।
এদিকে জুলাই স্পিরিট নিয়ে পাসপোর্ট অফিসের উপ-সহকারী পরিচালকের বিরূপ মন্তব্য করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ময়মনসিংহের অন্যতম সমন্বয়ক গোকুল সূত্রধর মানিক বলেন, এটা সবাই জানে পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ না দিলে এক সীমাহীন হেনস্তার শিকার হতে হয়। আমরা যে স্বপ্ন নিয়ে গণঅভ্যুত্থান করেছি, এদেশের জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে, দুর্নীতি থাকবে না। সেটা যদি আমরা না করতে পারি এবং অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও পাসপোর্ট অফিসের একজন কর্মকর্তা যদি বলে আমরা জুলাই-আগস্ট বুঝিনা, তবে সেটা অবশ্যই দুঃখজনক। উনি যদি জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ না করে, উনি যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স না হয়, তাহলে উনি তার ঐ চেয়ারে বসে থাকার যোগ্যতা রাখেন না বলে নৈতিকভাবে আমি মনে করি।