৫৪ বছর আগে পাড়ঘাট বধ্যভূমিতে একসঙ্গে গুলি করা হয়েছিল ১২ জন বাঙালিকে। সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান একজন কলিন্দ্র নাথ ও তাঁর ছেলে পবিন চন্দ্র রায়। ৫৪ বছর পর সেই একই জায়গায় ফিরে সহযাত্রীদের স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) গণহত্যা দিবসে দেবীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের আমন্ত্রণে তিনি আবারও এলেন সেই বধ্যভূমিতে। যেখানে লুটিয়ে পড়েছিলেন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এক জীবন্ত ইতিহাস হয়ে।
১৯৭১ সালের ২ জুন, সোনাহার মল্লিকাদহ গ্রামের কলিন্দ্র নাথসহ ৩০-৩৫ জন শরনার্থী হিসেবে ভারত গিয়েছিলেন। কিন্তু জন্মভূমির টানে কয়েকদিন পরই ফিরছিলেন। পথে হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তারা। তখন তাদের জিজ্ঞেস করা হয় "তোমরা বাংলাদেশ চাও, না পাকিস্তান?" জবাবে তারা দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, আমরা বাংলাদেশ চাই।
এই কথা বলার অপরাধেই ১২ জন পুরুষকে একসঙ্গে রশিতে বেঁধে গুলি চালায় পাক সেনারা। ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১১ জন। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন কলিন্দ্র নাথও। তবে ভাগ্যক্রমে বুকে বা মাথায় গুলি লাগেনি, গুলি তার বাম হাত ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। কয়েকজন নারী ও শিশু দূর থেকে এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেন।
রক্তাক্ত কলিন্দ্র নাথকে সেনারা মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে গেলে তার স্ত্রী ও ৮ বছরের ছেলে পবিন চন্দ্র রায় তাকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে যান। এরপর টানা সাত মাস চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হন। তবে সেই ক্ষতচিহ্ন আজও বহন করে চলেছেন, যেমন বহন করে চলেছেন ভয়াবহ গণহত্যার স্মৃতি।
এত বছর ধরে বিশেষ কোনো সরকারি স্বীকৃতি বা সহায়তা পাননি কলিন্দ্র নাথ। তবে উপজেলা প্রশাসন বধ্যভূমিতে গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে, যেখানে তার নাম আহতদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আজ গণহত্যা দিবসে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে ডেকে আনা হয় এবং কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। বধ্যভূমিতে পা রেখেই তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। সহযাত্রীদের কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় উপস্থিত ইউএনও মাহমুদুল হাসান তাকে সান্ত্বনা দেন এবং উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
১০৫ বছর বয়সী কলিন্দ্র নাথ এখন লাঠিতে ভর করে চলাফেরা করেন। তার চোখে এখনও সেই রাতের ভয়াবহ দৃশ্য ভাসে। গণহত্যার শিকার সহযাত্রীদের স্মরণ করে তিনি বলেন, সেদিন মরতে পারলেই হয়তো ভালো হতো। বেঁচে থেকেও তাদের যন্ত্রণার ভাগী হয়ে আছি।
এ সময় তার ছেলে পবিন চন্দ্র রায় বলেন, আমার বাবার জীবনটাই ইতিহাস। কিন্তু এত বছরেও তার জন্য কেউ কিছু করেনি। আজ অন্তত তাকে এখানে ডেকে এনে সম্মানিত করা হয়েছে, এটাই বড় প্রাপ্তি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, আমরা এতদিন এই ইতিহাস জানতাম না। জানতে পেরে তাকে সম্মান জানাতে চেয়েছি। তিনি জীবন্ত ইতিহাস, তার জন্য আমাদের যতটুকু করার সুযোগ আছে, তা আমরা করব।
গণহত্যার ৫৪ বছর পরও ইতিহাসের সেই ক্ষত রয়ে গেছে। কলিন্দ্র নাথের মতো জীবন্ত সাক্ষীদের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সহযোগিতার দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা।
এসআর