“এসো হে বৈশাখ, এসো এসো”—এই গানটি বাজলেই রাজশাহীর চারদিকে যেন এক আবেগ ছড়িয়ে পড়ত। পদ্মার পাড়ে, শহরের অলিগলি কিংবা গ্রামীণ চত্বরে বৈশাখের সকালে একধরনের অন্যরকম উত্তেজনা দেখা যেত। সময় বদলেছে, বদলে গেছে রাজশাহীর নববর্ষ উদযাপনও। হারিয়ে যাচ্ছে সেই আত্মিক আবেগ, মাটির ঘ্রাণ মেশানো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী আয়োজন। এখন যেন পহেলা বৈশাখ শুধুই একটি ‘ইভেন্ট’, যা উদযাপনের চেয়ে প্রদর্শন ও ট্রেন্ডের অংশ হয়ে উঠেছে।
রাজশাহীতে নববর্ষ মানেই ছিল মিলনমেলা। সকাল সকাল সবাই লাল-সাদা পোশাকে সেজে বের হত। কেউ যাচ্ছেন বটতলায় আয়োজিত বৈশাখী মেলায়, কেউ বা যাচ্ছেন পদ্মা পাড়ে বাউল গানের আসরে। হালখাতা হতো শহরের বাজারগুলোতে। ব্যবসায়ীরা মিষ্টি বিতরণ করতেন পুরোনো দেনা-পাওনার হিসাব মিলিয়ে নতুন বছরের শুভসূচনা করতে।
গ্রামাঞ্চলে ছিল নাচ, গান, যাত্রাপালা, কাব্যপাঠ ও পালাগানের আয়োজন। স্কুল-কলেজে হতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মেয়েরা আলপনা এঁকে বাড়ির উঠোন সাজাত। বউ-ঝিরা রান্না করত পান্তা-ইলিশ, সেমাই, পায়েস, খিচুড়ি। সেই খাবার ভাগাভাগি হতো প্রতিবেশীদের সাথে। তখন নববর্ষ ছিল একান্তই লোকজ, মাটির গন্ধে ভরা।
সোমবার (১৪ এপ্রিল) রাজশাহী শহরে লক্ষ্য করা গেছে, নববর্ষ মানে এখন ‘সেলফি’, ‘লাইভ ভিডিও’, ফিল্টার দেওয়া ছবি এবং ব্র্যান্ডিং। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা এখনও হয়, কিন্তু সেখানে যারা অংশ নেন তাদের বড় একটা অংশ অংশগ্রহণ করেন ছবি তোলার জন্য। অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না শোভাযাত্রার মূর্তি বা মুখোশের সাংস্কৃতিক ব্যঞ্জনা কী।
রাজশাহীর বাজারগুলো ঘুরলে দেখা যায়, এখন নববর্ষ উপলক্ষে ফ্যাশন হাউজগুলোতে বিশেষ অফার চলে। টিশার্ট, হুডি, ডিজাইনার পাঞ্জাবি আর মেকআপ সেট নিয়ে যেন এক রকম প্রতিযোগিতা। আগে যেখানে পহেলা বৈশাখ মানেই ছিল শুদ্ধ সংস্কৃতি ও মাটির গন্ধ, এখন তা হয়ে উঠেছে কৃত্রিম রঙে মোড়ানো ফ্যাশন শো।
২০১৫ সালের পর থেকে দেশব্যাপী নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর হওয়ায় রাজশাহীতেও পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানগুলো সীমিত আকারে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শহরের পদ্মার চরে, থিম পার্কে কিংবা চারুকলার সামনে অনুষ্ঠান হলেও, তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হয়। সন্ধ্যার পর কোনো রকম মেলা বা গানের আসর চলে না।
নগরবাসী শামসুল ইসলাম (৬২) বলেন, “আগে বৈশাখের রাতে আমরা যাত্রা বা বাউল গান দেখতে যেতাম। এখন তো সন্ধ্যার পর রাস্তাই ফাঁকা হয়ে যায়। নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে ঠিকই, কিন্তু সংস্কৃতি তো এর বলি হতে পারে না!”
শুধু শহরেই নয়, রাজশাহীর গ্রামাঞ্চলেও নববর্ষ হারিয়েছে তার স্বকীয়তা। আগের মত বৈশাখী মেলা আর হয় না। অনেক জায়গায় হালখাতা অনুষ্ঠানও বন্ধ হয়ে গেছে। তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ নেই পল্লীগীতি, পালাগান বা নাচ-গানে। মোবাইল ফোন আর সোশ্যাল মিডিয়া যেন তাদের সংস্কৃতির উৎসে আগ্রহ হারিয়ে দিয়েছে।
বাগমারা উপজেলার স্কুলশিক্ষক ফজলুল করিম (৫৭) বলেন, “আমরা ছোটবেলায় দল বেঁধে নববর্ষে নাটক করতাম, বাঁশি বাজাতাম। এখনকার ছেলেমেয়েরা নববর্ষ মানেই টিকটক বা ফেসবুক লাইভ মনে করে।”
নববর্ষের অনেক অনুষ্ঠান এখন স্পনসর-নির্ভর। ছোট ছোট সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলো অনুষ্ঠান করতে পারে না বাজেটের অভাবে। তাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে বড় বড় ব্র্যান্ড। “নববর্ষ উৎসব এখন একটা মার্কেটিং ইভেন্টে পরিণত হয়েছে”—বললেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সজল মাহমুদ।
টিভি অনুষ্ঠানগুলোতেও দেশজ সংস্কৃতির বদলে জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতা চলে। লোকজ শিল্পীদের জায়গায় উঠে আসে ‘সেলিব্রিটি পারফর্মার’। এর ফলে ঐতিহ্যগত উপস্থাপন কমে যাচ্ছে।
তবে সব তরুণই যে ঐতিহ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তা নয়। অনেকেই চান পুরনো সেই আবেগ আবার ফিরিয়ে আনতে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারহানা হক বলেন, “আমরা বন্ধুরা মিলে বৈশাখে হাতের আলপনা দেই, কবিতা আবৃত্তি করি। কিন্তু চারপাশে সবাই শুধু ছবি তুলতে ব্যস্ত। কেউ গান শুনে না, কেউ কবিতা শোনে না। এটা কষ্ট দেয়।”
রাজশাহীর নববর্ষ সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। স্থানীয় প্রশাসন, সংস্কৃতিক সংগঠন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একসাথে পরিকল্পনা করলে শহর ও গ্রামে বৈশাখ ফিরে পেতে পারে প্রাণ। গ্রামীণ মেলা, পালাগান, নাচগান, কবিতা পাঠ—এসব আয়োজন বাড়াতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহ দিতে হবে লোকজ সংস্কৃতি চর্চায়। স্পনসরের টাকা খরচ হোক শুদ্ধ সংস্কৃতির জন্য, ফ্যাশন শো বা ডিজে পার্টির জন্য নয়।
রাজশাহী এক সময় ছিল লোকজ সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। পহেলা বৈশাখে সেই প্রাণের স্পন্দন দেখা যেত চোখে পড়ার মত। কিন্তু এখন তার অনেকটাই মুছে গেছে। আধুনিকতার ছোঁয়া নিতে গিয়ে রাজশাহী যেন হারিয়ে ফেলেছে তার শিকড়ের টান। নববর্ষ উদযাপন হতে হবে এমনভাবে, যেখানে থাকবে আধুনিকতার ছোঁয়া, কিন্তু তাতে হারিয়ে যাবে না ঐতিহ্যের আস্বাদ। নয়তো ভবিষ্যতের কোনো এক সময় পহেলা বৈশাখ হয়তো থাকবে ক্যালেন্ডারে, কিন্তু মানুষের হৃদয়ে থাকবে না বলে ধারণা করছেন সুশীল সমাজ।