মানুষের জীবনের বৃদ্ধ বয়স হলো শেষ ধাপ, সেই বয়সে পিতা-মাতার খেয়াল না রাখলে হবে যে পাপ। তুমিও যে আমার মতো হবে একদিন বৃদ্ধ বাপ, দিচ্ছি না আমি তোমায় অভিশাপ। বাস্তবতায় আমাকে দেখে কি উপলব্ধি হচ্ছে আজ? তোমারও যে চামরায় পড়িবে একদিন এইরকম ভাঁজ। আনন্দময় মূহুর্ত বা বড় কোন উৎসবের আমেজ আসলেই এই কবিতার লাইনগুলোই যেনো শেষ সম্বল হয়ে মনের কোনে উঁকি দেয় বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করা বাসিন্দাদের মনে।
ঈদুল ফিতরের আর মাত্র একদিন বাকী। চারদিকে উৎসবের আমেজ, ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে দুর দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন পরিবারের স্বজনা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কেনাকাটায় ছুটছেন হাজারো মানুষ।
ধনী-গরিব সবাই যখন ঈদ আনন্দে মশগুল সেসময়ও দূর নির্জন জায়গায় প্রিয়জন ছাড়া নিভৃতে বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জল ফেলছেন একদল মানুষ। এ মানুষগুলোর মধ্যে অনেকেই আশায় আছেন এবারের ঈদে তার স্বজন বা সন্তানরা কেউ আসবে। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে সন্ধ্যা ও রাত পর্যন্ত অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মানুষগুলো।
সব থেকেও যেন কেউ নেই তাদের। পরিবার থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে এসব মানুষদের। এখন শেষ বয়সে একা জীবন পার করছেন তারা। জানালার কাছে একা বসে তীক্ষ্ণ চাউনিতে চেয়ে আছেন বৃদ্ধরা।
এমনি নির্মম গল্প ভোলার বৃদ্ধ নিবাসের অসহায় বাবাদের। যাদের কেউ ভালো নেই। বৃদ্ধ নিবাস থেকে তাদের তিন বেলা খাবার দেয়া হলেও স্বজন থেকে আলাদা থাকতে হচ্ছে। এমন কষ্ট আর অসহায়ত্বের কথা কারো কাছে বলতে পারছেন না। তবুও সন্তানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই তাদের। বৃদ্ধ নিবাসের বাসিন্দা বৃদ্ধ বাবাদের এমনি গল্প যা অত্যান্ত নির্মম বলেই মনে করছেন অনেকে। তবে বাবাদের যেন এভাবে রাখা না হয়, সন্তানদের প্রতি সেই অনুরোধ সচেতন মহলের।
ভোলার বিশিষ্ট সমাজসেবক নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডশনের অর্থায়নে পরিচালিত ভোলা সদরের পৌর কাঠালির বৃদ্ধ নিবাসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একজন সামছুল হক বৃদ্ধ নিবাসে বসে নিপুন হাতে জাল বুনছেন, কি কাজে লাগাবেন সেই জাল নিজেও জানেন না। সময় কাটাতেই হয়তো জাল বুনছেন তিনি। সদর উপজেলার আলীনগর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন সামসল হক। তার ৬ মেয়ে এক ছেলে। সব মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন । ঘরে আছে একমাত্র ছেলের বউ। কিন্তু তার আচরণ সন্তোষজনক না, তার পরেও কোন অভিযোগ নেই তার। বললেন, এখানেই ভালো আছেন তিনি। সন্তানদের প্রতি কোন অভিযোগ অভিমান নেই তার।
আ.রশিদ নামের এক বৃদ্ধ বাবা তার ছেলেকে বৃদ্ধাশ্রমে এসে দেখা করতে নিষেধ করেছেন। বললেন, ছেলের সম্মানের কথা বিবেচনা করেই আসতে নিষেধ করা হয়েছে। চাপা কষ্ট বুকে চেপে রেখে বললেন বৃদ্ধাশ্রমে ভালো আছেন তিনি। সংসার জীবনে কোন অভাব ছিলো না তার। তারপরেও এখানে থাকি। মাঝে মধ্যে বাড়িতে যাই সবার সাথে দেখা করতে।
সামসল হক কিংবা আ.রশিদই নয়, তাদের মত একই অবস্থা মন্নান, ইউনুসসহ আরো অনেক বাবাদের। তাদের প্রত্যেকের বৃদ্ধাশ্রমে আসার গল্পটা ভিন্ন হলেও পরিনতি যেন একই।
এ বৃদ্ধনিবাসে এ থাকেন ১৭জন বৃদ্ধ বাবা। খাবার-সেবা যত্ন নিয়মিত চললেও সন্তানদের কথা মনে করে কাঁদেন তারা। সব কিছু থেকেও যেনো, কিছুই নেই তাদের। জীবন যুদ্ধে নেমে ধরেছেন সংসারের হাল, করেছেন সন্তানদের জন্য অর্থ সম্পদ। সময়ের ব্যবধানে আজ তারা বাড়ি হারা হয়ে পরেছেন।
ওই বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজার সালেহ উদ্দিন সেলিম বলেন, বাবাদের এভাবে বৃদ্ধাশ্রমে যে সন্তানরা রেখেছেন তারাও তো একদিন বাবা হবেন। তখন তাদের পরিনতিও এরকম হতে পারে। প্রত্যেক সন্তানদের উচিত তাদের বাবাদের কাছে রাখা। এমন দিন আসবে তারাও বৃদ্ধ হবে।
প্রতিষ্ঠাতা নিজাম উদ্দিন জানান, তার অধ্যায়নর অবস্থায় বাবা মা মারা যান। বাবা মায়ের সেবাযত্ন করতে না পারার আক্ষেপ থেকেই বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলেন তিনি। ঈদ কিংবা কোন উৎসবে সময় কাটান বৃদ্ধ নিবাশের বৃদ্ধদের সাথে। নিজেই উৎসবে মেতে উঠেন তাদের সাথে।
পিএম