আমাদের দেশের প্রচালিত আইনানুযায়ী বিয়ের বয়স মেয়ে ১৮, এবং ছেলে ২১ বছর। মূলত বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন। যেখানে দুইটি পরিবারের দুটি ছেলে ও মেয়ে একে অপরের সাথে ধর্মীয় রীতি মেনে একটি পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আমাদের সমাজে সাধারণত একটা সময়ে এসে বাবা মা তাদের সন্তানের পরে বিয়ে বিষয়টি চাপিয়ে দেন। পারিবারিক সম্মানের জন্য ছেলে মেয়েরাও মুখ বুজে তাদের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়।
তবে আপনি কি জানেন বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজের ব্যাপারে, যেমন; তার নিজস্ব চাওয়া, মানসিক অবস্থা, জীবনের লক্ষ্য ও সঙ্গীর ব্যাপারে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি আপনার মানসিক প্রস্তুতি, আর্থিক নিরাপত্তা এবং নিজের চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে আপনার নেওয়া এই মূল্যবান সিদ্ধান্ত সুন্দর দাম্পত্য জীবনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।
সেক্ষেত্রে কম বয়সে বিয়ে করলে অনেক সময়ই বিপরীত অবস্থা তৈরি হতে পারে। কারণ কম বয়সে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনেকেরই থাকে না এছাড়াও এর অনেক সম্ভাব্য সংকটও আছে। কেউ কেউ আগেভাগে বিয়ে করে ফেলছে দেখেই বিয়ে ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি যে কারো জীবনের একটি অন্যতম বড় পদক্ষেপ। কেননা বিয়ের সিদ্ধান্ত যতটা গভীর ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। চলুন জেনে নেই কম বয়সে বিয়ে করা উচিত নয় যে সকল কারণে
জীবনমুখী অভিজ্ঞতার ঘাটতি
কম বয়সে বিয়েকে নিরুৎসাহিত করার একটি অন্যতম কারণ হলো জীবনমুখী অভিজ্ঞতার অভাব। নিজেকে চিনতে, জীবনের লক্ষ্য ও চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হতে অনেক ক্ষেত্রেই তরুণদের সময় প্রয়োজন হয়। তাই তাড়াহুড়া করে এমন কাউকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না, যে কি না তার সঙ্গে জীবন কাটানোর জন্য উপযুক্ত নয়। তাছাড়া এই অবস্থায় বিয়ে করলে সংশ্লিষ্ট আরও নানা রকম দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা তাদের ওপর চলে আসবে, যা সামলানোর মতো অভিজ্ঞতা তাদের নেই। ফলে দাম্পত্য জীবনে নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
আর্থিক প্রস্তুতি না থাকা
আর্থিকভাবে প্রস্তুত না থাকা আরও একটি অন্যতম বিষয়, যার কারণে কম বয়সে বিয়ের পরিণতি সুখকর নাও হতে পারে। আমাদের সমাজে পড়াশুনা শেষ করার সাথে সাথে চাকরি পাওয়া আর সোনার হরিণ পাওয়া একি কথা।
পড়াশুনা শেষ করার পরও অধিকাংশ ছেলে মেয়েরা যেখানে বেকার থাকে সেখানে তরুণ কোনো দম্পতির নিরাপদ নির্দিষ্ট আয়ের উৎস না থাকার আশঙ্কা অনেক ক্ষেত্রে বেশি থাকে, যার ফলে এমতাবস্থায় বিয়ে করলে তাদের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং তাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিংবা সবেমাত্র অল্প বেতনে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা কোনো জুটির কথা ভাবুন। তাদের জন্য কিন্তু বিয়ের পর একে অন্যকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। হয়তো তাদের একজনের বেতনে মাস কাটাতে হবে, যার প্রভাব পড়বে তাদের সম্পর্কে।
ক্ষুদ্র সামাজিক পরিমণ্ডল
কম বয়সী দম্পতিদের সামাজিক পরিমণ্ডলও অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র পরিসরের হয়ে থাকে। যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে সম্বল কিংবা সহায়তার ঘাটতি দেখা দিতে পারে। বয়স কম হলে এলাকায় পরিচিতি পাওয়া, প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করা কিংবা বিভিন্ন সামাজিক পরিমণ্ডল খুঁজে পাওয়ার মতো কঠিন কাজগুলো তাদের করতে হয়। ফলে পারিপার্শ্বিক সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারটি চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে তখন তাদের জন্য।
ব্যক্তিত্বের অসম্পূর্ণ বিকাশ
ব্যক্তিত্বের বিকাশ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া; বিয়ের মতো একটি সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ থেকে যার পথটা তেমন মসৃণ নাও হতে পারে। তারুণ্যেও নিজেকে চেনার, নিজের চাওয়া-পাওয়াকে বোঝার সফর চলতে থাকে। দায়িত্বশীল একটি সম্পর্কে থেকে এই সফর অনেকসময়ই খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠে।
প্রাধান্যের পরিবর্তন
সময়ের সঙ্গে আমাদের জীবনে প্রাধান্য বদলে যেতে থাকে। ৩০ বা ৪০ এর ঘরে বয়স থাকতে যেসব বিষয় আমরা প্রাধান্য দিই, তা ২০ এর ঘরে যা প্রাধান্য দেই তার চেয়ে যথেষ্ট আলাদা হয়। সাধারণত কম বয়সে আমাদের প্রাধান্য কোনো জায়গায় স্থির তাকে না। এক্ষেত্রে যদি স্বামী-স্ত্রী ২ জনই একই সমান্তরালে না থাকেন, তবে তা সম্পর্ক তিক্ত করতে পারে।
বিয়ে বিচ্ছেদের উচ্চ ঝুঁকি
এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিকভাবে পরিপক্ক হয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসা দম্পতিদের তুলনায় অল্প বয়সে বিয়ে করা দম্পতির মাঝে বিচ্ছেদের হার অপেক্ষাকৃত বেশি। মানসিক অপরিপক্কতা, জীবনমুখী অভিজ্ঞতার অভাব এবং আর্থিক অনিশ্চয়তা এসব বিচ্ছেদের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করে।
জীবনের অন্যান্য সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলা
অল্প বয়সে বিয়ের জন্য নানা রকম মাশুল গুণতে হতে পারে। সংসার গড়ায় অঙ্গীকার করতে গিয়ে হয়তো ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদে অনুশোচনা ও ক্ষোভের কারণ হতে পারে।
মানসিক পরিপক্কতার ঘাটতি
যেকোনো সম্পর্কের জন্য মানসিক পরিপক্কতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি অর্জন করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয়। অল্প বয়সে বিয়ে করলে, এর সঙ্গে আসা নানা রকম সংকট সামাল দিতে যে মানসিক অবস্থা থাকা দরকার তা নাও থাকতে পারে।
বিয়ে করলে অনেক দায়িত্ব নিতে হয়। বিয়ে করলেন অথচ স্ত্রী এবং পরিবারের দায়িত্ব নিতে শিখলেন না, তা হয় না। তাই অনেকেই মনে করেন, ২২ কি ২৩ হলে সেই বয়সে দায়িত্ব নেয়ার ক্ষমতা কম থাকে। এছাড়াও মানসিক পরিপক্কতার ঘাটতির কারণে কোনো তরুণ দম্পতিকে ফলপ্রসূ উপায়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে এবং সম্পর্কের কোনো দ্বন্দ্ব সামাল দিতে যথেষ্ট বেগ পেতে পারে। দাম্পত্য জীবনের সংকটগুলো সঠিকভাবে বুঝতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে, তাদের তখনও আত্ম-সচেতনতা এবং মানসিক নিয়ন্ত্রণ দক্ষতা বিকাশের প্রয়োজন হতে পারে।