অপেক্ষার প্রহর বড় কষ্টের, সেই কষ্টের প্রহর পেরিয়ে অবশেষে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শেষে জীবনের চরম চড়াই উতরাই পেরিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে বাবা মায়ের বুকে ফিরলেন নাবিক রাজু।
সোমালিয় জলদস্যুর কবল থেকে মুক্ত হওয়া জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর এবি (অ্যাবল সি ম্যান) হিসেবে কর্মরত নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের মোহাম্মদ আনারুল হক রাজু দীর্ঘ ২ মাস পর আপন ঠিকানায় ফিরে এলেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের রামপুর গ্রামের আজিজুল হক মাস্টার বাড়ি নিজ পিত্রালয়ে মঙ্গলবার (১৪ মে) রাত ১১টায় পৌঁছেন রাজু। সন্তানকে পেয়ে এসময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বাবা আজিজুল হক মাস্টার ও মা দৌলত আরা বেগম। রাজুকে পেয়ে স্বজনদের উচ্ছ্বাস বাড়ে কয়েকগুণ, অনেকের চোখেই তখন আনন্দ অশ্রু। রাজুকে একনজর দেখতে ছুটে আসেন আত্মীয় স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরা।
দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে রাজু সবার ছোট। তিনি বামনী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর বামনী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। চট্টগ্রামের ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট (এনএমআই) থেকে সিডিসি কোর্স সম্পন্ন করেন। গত ১২ মার্চ দুপুরে শিল্প গ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ান দস্যুরা। অস্ত্রের মুখে সেখানে থাকা কোম্পানীগঞ্জের রাজুসহ ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় জাহাজের ইন্টারনেট সংযোগও। ছিনিয়ে নেওয়া হয় নাবিকদের কাছে থাকা মোবাইল ও সঙ্গে থাকা ডলার।
ছেলেকে ফিরে পেয়ে রাজুর মা দৌলত আরা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছেলের জন্য গরুর গোশত, মুরগীর গোশত, মাছ ও শিমের বিচি তরকারি রান্না করেছেন। তিনি বলেন, কত কষ্টে আমার দিন কেটেছে, এক আল্লাহ জানে আর আমি জানি। আল্লাহর ওপর ভরসা ছিল। বড় বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে আমার ছেলে আমার বুকে ফিরেছে। আর কারও পরিবার যাতে এমন বিপদে না পড়ে, সে দোয়া করি।
রাজুর বাবা আজিজুল হক বলেন, গেল রমজানের ঈদ আমাদের জন্য ছিল বেদনাদায়ক কষ্টের দিন। কিন্তু আজ ছেলেকে ফিরে পেয়েছি আজ আমাদের ঈদ। নামাজ পড়ে মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। ছেলের জন্য নতুন পাকা ঘর করেছি। এবার ছেলেকে বিয়ে করাব। শিপিং কোম্পানি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল বলেই এত দ্রুত তাদেরকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
বাবা মায়ের কাছে ফিরতে পেরে রাজুর চোখেও আনন্দ অশ্রু। তিনি বলেন, গত ১২ মার্চ আমাদের জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ান দস্যুরা। আমাদের সবসময় অস্ত্রের মুখে জিম্মি রেখেছে তারা। বিভীষিকাময় সময় পার করেছি সবাই। পরিবারের কাছে ফেরা ছিল দুঃস্বপ্নের মত। এত দ্রুত কোনও জাহাজ জিম্মি থেকে মুক্তি পায়নি। আমাদের কোম্পানি আন্তরিক ছিল বলেই আমরা বাড়িতে আসতে পেরেছি। আমাদের কোম্পানির সবাইকে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী বলেন, জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হয়ে বাবা মায়ের বুকে ফিরতে পারা যে কী আনন্দ তা সবার উপলব্ধি হবে না। কেবল ২৩ জন নাবিকের ২৩টি পরিবার নয়। পুরো বাংলাদেশ তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। রাজুর পরিবারের সাথে আমার যোগাযোগ আছে। রাজুর ঘরে আজ আনন্দ। আমি পুরো পরিবারের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কামনা করছি।
উল্লেখ্য, কার্গো নিয়ে আফ্রিকার বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ দুপুরে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজকে জিম্মি করে সোমালিয়ান দস্যুরা। অস্ত্রের মুখে দস্যুরা সেখানে থাকা ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখে। আটকের পর জলদস্যুরা জাহাজটিকে সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যায়।
পরে সেখানে জিম্মিকালীন সময়ে মালিকপক্ষের তৎপরতায় জলদস্যুদের সাথে সমঝোতা শেষে তাদের দাবি অনুযায়ী জলদস্যুরা মুক্তিপণ বুঝে নেয়। একটি বিশেষ উড়োজাহাজে মুক্তিপণ বাবদ ৩ ব্যাগ ডলার এমভি আবদুল্লাহর পাশে সাগরে ছুড়ে ফেলা হলে স্পিড বোট দিয়ে দস্যুরা ৩টি ব্যাগ কুড়িয়ে নেয়। মুক্তিপণ নিয়ে ১৪ এপ্রিল জলদস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে যায়। দস্যুমুক্ত হয়ে ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে সোমালিয়ার উপকূল থেকে আরব আমিরাতের পথে রওনা দেয় এমভি আবদুল্লাহ। ২১ এপ্রিল এমভি আবদুল্লাহ সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়াহ পৌঁছে। সেখানে কার্গো খালাস করে জাহাজটি একই দেশের মিনা সাকার থেকে কার্গো লোড করে দেশের উদ্দেশে রওনা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়।
এফএস