২০২০ সালের শেষের দিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ে যোগদান করেন তন্তুমনি চাকমা। এরমধ্যে শুধু তিন বছরই কাটিয়েছেন মাদকের করিডোর টেকনাফে। গত ১০ মাস ধরে উপ-পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন কক্সবাজার কার্যালয়ে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে ঘুরে ফিরে মাদকের হটস্পট খ্যাত এই জেলায় চাকরি করে যাচ্ছেন তিনি।
এই কর্মকর্তার ব্যক্তিগত তথ্য বলছে, যতদিন চাকরির মেয়াদ অর্থাৎ তার বেশিরভাগ সময় মাদকের প্রাণকেন্দ্র কক্সবাজারে কর্মরত। বদলি যেন তার ডিকশনারিতে নেই। চাকরির শুরুতে মাঠে পদায়ন পান। নানা জায়গায় মাত্র কয়েক বছর চাকরির পর আর কক্সবাজার জেলার বাইরে যেতে হয়নি। ক্ষমতা, প্রভাব ও আওয়ামী লীগ সরকারের অতি-আস্থাভাজন হয়ে উঠাকে চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যবহার করে কক্সবাজারে রয়েছেন বহাল তবিয়তে। জব্দ করা মাদক গায়েব করে ব্যবসা, আটক বাণিজ্য কিংবা চোরাকারবারিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে দু’হাতে কামিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। প্রায় পাঁচ ধরে কক্সবাজারের মধু খেয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন ফন্দি-ফিকির করে এখানে থেকেই উচ্চপদে পদোন্নতি বাগিয়ে নিতে মরিয়া এই কর্মকর্তা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে একই জেলায় কর্মরত থাকার কারণে মাদক কর্মকর্তা তন্তুমনি চাকমার সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের সখ্যতা গড়ে উঠেছে। স্থানীয়দের দাবি, তার ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী মাদক নেটওয়ার্ক, যা পুরো কক্সবাজার শহরে মাদক সাপ্লাই করে যাচ্ছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত তন্তুমনি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। মাদক চোরাচালান থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি পর্যন্ত; মাদক কার্যালয়ের সব অপরাধেই তার নাম জড়িয়ে আছে। মাদক উদ্ধার অভিযানে বড় বড় নাটকের জন্ম দেন তিনি। উদ্ধারকৃত মাদকের সিংহভাগই গোপনে তার ডিলারদের কাছে বিক্রি করেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানে গেছে, অভিযান চালানোর নামে ছোটখাটো ডিলারদের আটক করা হয়। আবার জব্দ তালিকা কিংবা আটকদের নিয়ে করা হয় কয়েক ধাপের বাণিজ্য। শুধু তাই নয়, টাকার বিনিময়ে একজনের মাদকে আসামি করা হয় অন্যজনকে। ২০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করে কার্যালয়ে নিতে নিতে সেই মাদকের চালান অর্ধেকে পরিণত হয়। কখনো কখনো বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ের মাদকসহ আটকদের ছেড়ে দেওয়ার জনশ্রুতিও রয়েছে।
সম্প্রতি কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি অভিযানের তথ্য প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তার মাদক উদ্ধারের অধিকাংশ অভিযান বির্তকিত। ইয়াবা, হিরোইন ও নগদ অর্থ আত্মসাৎ যেন তার নেশায় পরিণত হয়েছে।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি আরফা বেগম নামের এক নারীকে ৪ হাজার পিস ইয়াবা ও নগদ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকাসহ আটক করা হলেও মামলায় মাত্র ২ হাজার পিস ইয়াবা দেখানো হয়—অর্থাৎ বাকি ২ হাজার পিস ইয়াবা ও পুরো নগদ টাকা তিনি নিজেই মেরে দিয়েছেন। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রামুতে বোধন বড়ুয়া ও উসাই মং মারমা নামের দুজনকে ২০ হাজার পিস ইয়াবা ও নগদ ২ লাখ টাকাসহ আটক করা হয়। তবে তাদের বিরুদ্ধে করা মামলায় ১৫ হাজার পিস ইয়াবা দেখানো হয়—অবশিষ্ট ৫ হাজার পিস ইয়াবা ও নগদ অর্থের কোনো হদিস নেই। গত ২ মার্চ কক্সবাজার ইসমাইল ড্রাইভার নামের এক ব্যক্তিকে ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক করা হলেও কাগজে-কলমে ৮ হাজার পিস ইয়াবা দেখানো হয়।
সূত্র জানান, কক্সবাজারের পোস্টিং যেন মাদক কর্মকর্তা তন্তুমনির কাছে সিঙ্গাপুরে পরিণত হয়েছে। এখানে যোগদানের পর থেকে স্বল্প বেতনের এই কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠেছেন। বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক বনে যাওয়া এই কর্মকর্তার গ্রামে তৈরি করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, যার মূল্য কোটি টাকারও বেশি। মাদক উদ্ধার অভিযানের সময় বড় ধরনের কারসাজি করেন মাদকের এই কর্মকর্তা। উদ্ধার করা মাদকের সামান্য অংশ মামলার জব্দ তালিকায় দেখানো হলেও, বাকি অংশ গোপনে তার নিয়োগকৃত ডিলারদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এভাবেই গড়ে তুলেছেন তিনি এক শক্তিশালী মাদক চক্র।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই কর্মকর্তা শুধু মাদক ব্যবসায় জড়িতই নন, বরং মাদক কারবারিদের কাছ থেকে মাসোয়ারা, চাঁদাবাজি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মতো অপরাধেও যুক্ত। তার বিরুদ্ধে এসব বেশ পুরোনো হলেও অদৃশ্য শক্তির কারণে তিনি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক যুবক বলেন, মাদক কর্মকর্তা তন্তুমনি চাকমার ঘুষ গ্রহণ, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অপরাধীদের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ বহু পুরনো। যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাত করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। তার ব্যাংক হিসাব ও সম্পদের পরিমাণ তার সরকারি চাকরির আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীর দেওয়া স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে তন্তুমনির নাম। একাধিক মাদক ব্যবসায়ী বলছেন, টাকার বিনিময়ে মামলা দেওয়া হয়। মাদক জব্দ করে তা অনেক সময় নিজের কাছে রেখে দেন। পাশাপাশি অর্থের বিনিময়ে নষ্ট করে ফেলেন মামলায় ব্যবহার করা যায়, এমন আলামতও। তার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষকদের সহযোগিতার অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া, তিনি নিয়মিত মাসোহারা গ্রহণ করেন এবং মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার তথ্য আগেই পাচার করেন।
শুধু তন্তুমনি নন, তার মতো কক্সবাজারের অনেক মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাই মাদক বিক্রি, ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। কারো কারো বিরুদ্ধে এলাকার নিরীহ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে ঘুষ আদায় করার অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্বোচ্চার নাগরিকরা তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত তন্তুমনির শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভ্যন্তরে দুর্নীতি নির্মূল করা না গেলে মাদক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কোনোভাবেই সফল হবে না।
জানতে চাইলে অভিযুক্ত তন্তুমনি চাকমার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'ভাই, আপনি আমাকে বদলির ব্যবস্থা করে দিন, মিষ্টি খাওয়াবো।' তবে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন সদুত্তর না দিয়ে দাম্ভিকতার সঙ্গে প্রতিবেদককে তার অফিসে গিয়ে বা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে ফোনের সংযোগটি বিছিন্ন করে দেন।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক (চিকিৎসা ও পুনর্বাসন) মো. মাসুদ হোসেন বলেন, 'আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছি। দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
এসকে/আরআই