বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ওপর দীর্ঘদিনের পুরনো নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পরিবর্তনের যে দাবি মৎস্য গবেষক ও জেলেরা করে আসছিলেন, অবশেষে তার বাস্তবায়ন হলো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামীতে বাংলাদেশ ও ভারতের জলসীমায় প্রায় একই সময়ে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। মৎস্য গবেষক, ব্যবসায়ী ও জেলেরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সুরক্ষিত থাকবে, উৎপাদন বাড়বে এবং জেলেদের ভোগান্তিও কমবে।
দেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা পরিবর্তন করে ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিনের নতুন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। দীর্ঘ গবেষণা ও জেলেদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ সময়সীমা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, যা এবার থেকে ভারতের নিষেধাজ্ঞার সঙ্গেও মিল থাকবে।
ভারতীয় জলসীমায় ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত ৬১ দিনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকে। ফলে এতদিন বাংলাদেশি জেলেরা যখন মাছ ধরতে পারতেন না, তখন ভারতীয় জেলেরা একই সাগরে নির্বিঘ্নে মাছ ধরতে পারতেন। এমনকি অভিযোগ রয়েছে, নিষেধাজ্ঞার সুযোগ নিয়ে অনেক ভারতীয় নৌযান বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে মাছ শিকার করত, যা দেশের মৎস্য খাতের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ ছিল। এবার সময়সীমা পুনর্বিন্যাসের ফলে দুই দেশের নিষেধাজ্ঞা প্রায় সমান্তরাল থাকবে, যা ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করবে।
বাংলাদেশে ২০১৫ সালে প্রথম বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়। প্রথমদিকে শুধুমাত্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলারগুলোর জন্য এই বিধিনিষেধ প্রযোজ্য ছিল, তবে ২০১৯ সাল থেকে সাধারণ নৌযানগুলোকেও এর আওতায় আনা হয়। উদ্দেশ্য ছিল মাছের সুষ্ঠু প্রজনন নিশ্চিত করা ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা।
তবে বাস্তবে দেখা যায়, নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা নিয়ে অসংগতি থাকায় দেশের জেলেরা বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। নিষেধাজ্ঞার ফলে যখন বাংলাদেশের জেলেরা মাছ ধরতে পারতেন না, তখন ভারতীয় জেলেরা সমুদ্রে মাছ আহরণ করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতেন। ফলস্বরূপ, নিষেধাজ্ঞা শেষে যখন বাংলাদেশি জেলেরা সমুদ্রে যেতেন, তখন পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যেত না।
এছাড়া মাছের প্রজননকালীন নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রায়ই দেখা যেতো, নিষেধাজ্ঞা শেষে মাছ ধরার সময় ডিম ভর্তি মাছ ধরা পড়ছে, যা মাছের বংশবিস্তারের জন্য ক্ষতিকর। তাই মৎস্য গবেষকরা বারবার নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পুননির্ধারণের সুপারিশ করছিলেন। অবশেষে সরকার সেই দাবি মেনে নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এই সময়সীমা পুনর্বিন্যাসের ফলে—মাছের প্রজননকাল সঠিকভাবে রক্ষা পাবে, ফলে সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা বাস্তবসম্মত হওয়ায় জেলেরা মাছ ধরার মৌসুমে পর্যাপ্ত মাছ পেয়ে তাদের আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন। দুই দেশের নিষেধাজ্ঞার সময় এক হওয়ায় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধভাবে মাছ ধরতে পারবে না। সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
দেশের মৎস্য গবেষকরা এই পরিবর্তনকে মৎস্য খাতের জন্য "টাইমলি ডিসিশন" হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশ ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষক বলেন, "আমরা অনেকদিন ধরেই বলছিলাম নিষেধাজ্ঞার সময় নির্ধারণ আরও বিজ্ঞানসম্মত হওয়া দরকার। এবার সরকার সেই দাবি মেনে নেওয়ায় আমরা আশা করছি, সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন আগের চেয়ে ২০-২৫% বৃদ্ধি পাবে।"
অনেক জেলে এই সিদ্ধান্তে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। চট্টগ্রাম নগরীর ফিশারি ঘাটের জেলে চন্দন ধর সময়ের কণ্ঠস্বর-কে বলেন, "আগে আমরা ৬৫ দিন না খেয়ে কষ্ট করতাম, কিন্তু নিষেধাজ্ঞা শেষে মাছ পেতাম না। এবার হয়তো আমাদের কষ্ট কমবে।"
বড় ট্রলার কোম্পানিগুলোও সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার মালিক ইলিয়াস উদ্দিন বলেন, "এটা সুন্দর একটা সিদ্ধান্ত। আমরা অনেকদিন ধরে বলছিলাম, দুই দেশের নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা এক হওয়া দরকার। অবশেষে সরকার আমাদের কথা শুনেছে।"
নিষেধাজ্ঞার নতুন সময়সীমা কার্যকর করতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকার এবার আরও কঠোর নজরদারি করবে যাতে নিষেধাজ্ঞার সময় ভারতীয় নৌযানগুলো বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করতে না পারে। এছাড়া নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের জন্য সরকারি সহায়তা আরও বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা চলছে।