আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি আগের মতো এখন আর চোখে পড়ে না। অথচ একসময় ঢেঁকি ছিল গ্রামীণ জনপদে চাল ও চালের গুঁড়া বা আটা তৈরি করার একমাত্র মাধ্যম। ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দে মুখরিত ছিল গ্রামীণ জনপদ। কিন্তু এখন ঢেঁকির সেই শব্দ আর শোনা যায় না। কাঠের ঢেঁকি এখন গ্রামীণ জনপদের বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য।
জানা যায়, আগে প্রায় সবার বাড়িতে ঢেঁকি ছিল। ঢেঁকিছাঁটা চাল ও চালের গুঁড়ার পিঠার গন্ধে মন জুড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন আর তা নেই। ঢেঁকি সাধারণত বরই, বাবলা ও জামগাছের কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। সাড়ে তিন থেকে চার হাত দৈর্ঘ্য, আর পৌনে এক হাত চওড়া। মাথার দিকে একটু পুরু এবং অগ্রভাগ সরু। মাথায় বসানো থাকে এক হাত পরিমাণের কাঠের দস্তা। এর মাথায় লাগানো থাকে লোহার গুলা। এর মুখ যে নির্দিষ্ট স্থানে পড়ে সে স্থানকে গড় বলে। এই গড়ে ভেজানো চালে পাড় দিয়ে তৈরি করা হয় গুঁড়া।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সত্তরের দশকের পর ইঞ্জিনচালিত ধানভাঙা কল আমদানি শুরু হওয়ার পর গ্রামাঞ্চল থেকে ঢেঁকি বিলীন হওয়া শুরু হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির পথে। গ্রামের মানুষ ভুলে গেছেন ঢেঁকিতে ছাঁটা চালের স্বাদ। যান্ত্রিক সভ্যতা গ্রাস করেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঢেঁকি শিল্পকে।
বাঙালি জীবনাচরণের আরেকটি বড় অংশ ছিল নবান্ন উৎসব। গ্রামাঞ্চলের মানুষের ভাষ্য, গ্রামে একসময় নতুন ধান ওঠাকে কেন্দ্র করে নবান্ন উৎসব হতো। সেই উৎসবে পরিবারের শিশু-কিশোররা কত আমোদ-আহ্লাদে নাচত আর গাইত। বাঙালি জীবনের এই উৎসবটার সঙ্গেও ছিল ঢেঁকির সম্পর্ক।
ঢেঁকিতে ছাঁটা চালের আটা থেকে তৈরি হতো নানা উপাদেয় রকমারি পিঠা। বাড়ি বাড়ি পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেত। একসময় গ্রামীণ জনপদে ‘ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া-দুলিয়া’ এ রকম নানা লোকগানের মাধ্যমে চালের গুঁড়া তৈরি করা হতো। গ্রামবাংলার নববধূ, কিষানি ও তরুণীরা নবান্ন উৎসবের জন্য বিভিন্ন ধরনের পিঠাপুলির আয়োজন করত। ঢেঁকির ঢেঁকুর-ঢুঁকুর মিষ্টি-মধুর শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মনের সুখে গান শুনতে শুনতে বৃদ্ধাদেরও চলত পান খাওয়ার আড্ডা, আজকাল যা কেবলই স্মৃতি।
বেদনা খাতুন নামে এক বৃদ্ধ নারী বলেন, ঘণ্টায় তারা পাঁচ কেজি চালের গুঁড়া তৈরি করতে পারেন। ভোর ৪টা থেকে শুরু করেন কাজ। কোনো কোনো দিন চাল বেশি হলে সারা রাতও সময় দিতে হয়। এ কাজে ছেলে ও মেয়ে স্বামী ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে তাকে সহযোগিতা করেন। তিনি জানান, সারা বছরই কম-বেশি তার এখানে চালের গুঁড়া তৈরি করতে মানুষ আসেন।
তবে বাংলাদেশের গ্রামগুলোয় ঘুরেও এখন ঢেঁকির দেখা মেলে না। কালের বিবর্তনে ঢেঁকি এখন শুধু ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে। দিন দিন ঢেঁকি বিলুপ্ত হলেও একে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। আগামী প্রজন্মরা যাতে বাংলার এসব সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মেলবন্ধন স্থাপন করতে পারে, সেজন্য সরকারি বা বেসরকারিভাবে উদ্যোগ এক মাত্র পথ।
এআই