জার্মানির রাজধানী বার্লিন ইউরোপের একটি ঐতিহাসিক শহর। বার্লিনকে বলা হয় ‘সিটি অব ক্রিয়েটিভ আইডিয়া’। অর্থাৎ নতুন ধারণা বা নতুন চিন্তার শহর হিসেবে বার্লিনের রয়েছে আলাদা একটি খ্যাতি। আর এ কারণেই ২০১৫ সালে ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা সম্মেলনের জন্য এ শহরটিকে বেছে নেয়া হয়। আয়োজকরা মনে করেন, এ শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলন থেকে সমগ্র বিশ্বকে দারিদ্র্য ও বেকারত্বমুক্ত করার একটি সুন্দর ধারণা বেরিয়ে আসবে। যে ধারণার হাত ধরে ভবিষ্যতে সামাজিক ব্যবসার আরো প্রসার ঘটবে।
দারিদ্র্য ও বেকারত্বমুক্ত এক পৃথিবী তৈরির স্বপ্নকে সামনে রেখে শুরু হয় চার দিনব্যাপী সামাজিক ব্যবসা শীর্ষ সম্মেলন-২০১৫। অংশগ্রহণকারীদের পারস্পরিক পরিচয় পর্বের মধ্য দিয়েই সম্মেলন শুরু হয়। বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশ থেকে সহস্রাধিক বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলো পূরণে কীভাবে সামাজিক ব্যবসা ভূমিকা রাখতে পারে, তার পথ খুঁজে বের করাই ছিল এ সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এ জন্য একাধিক সেমিনারের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল। ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস জার্মানির প্রধান নির্বাহী সাসকিয়া ব্রুচতেন জানান, আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান ৫০ জন আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞ এসব আলোচনায় অংশ নেবেন। এদের মধ্যে ছিলেন বৈজ্ঞানিক, সামাজিক ব্যবসা উদ্যোক্তা ও করপোরেট ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল ব্যক্তিরা।
বার্লিনে এ রকম একটি শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ আমার জন্য ছিল একটি স্বপ্নাতীত ব্যাপার। সবকিছুই খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। বিশ্বজুড়ে সামাজিক ব্যবসা যে কতটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। সামাজিক ব্যবসায় কীভাবে বদলে যাচ্ছে বিশ্ব, তা এই সম্মেলনে এসে বুঝতে পারলাম। পৃথিবীর ৪০টিরও বেশি দেশে ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার মডেল চালু হয়েছে, যা ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ধারণ করে চলেছে। বিভিন্ন দেশে ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে তার নামে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিশ্বে প্রতিদিন নানারকম ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে। আবার অনেক কিছুর উদ্ভাবন-উন্মোচনও ঘটে। জন্ম ও মৃত্যু হয় অনেকের। রোজকার সব ঘটনা কি আমরা মনে রাখি? তবে কিছু বিষয় স্থায়ীভাবে দাগ কাটে মানুষের মনে। কিছু ঘটনা ইতিহাসের পাতায় উঠে যায়। তেমনই একটি বিষয় হলো জার্মানির বার্লিন প্রাচীর। বার্লিন যাব আর ঐতিহাসিক বার্লিন প্রাচীর কোথায় তৈরি হয় এবং কেনই বা ভেঙে ফেলা হলো, তা দেখব না, জানব না তা কি করে হয়? বিকেলে চা বিরতির এক ফাঁকে শহরটি ঘুরে দেখার সুযোগ হারালাম না। কয়েকজন মিলে বের হয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য বার্লিন প্রাচীর দেখা। কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে গেলাম।
পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিকে বিভক্ত করার জন্য একটি প্রাচীর নির্মাণ করা হয়, যাকে বলা হয় বার্লিন প্রাচীর। যেটি ইতিহাসে পরিচিত হয়ে আছে পশ্চিম জার্মানি ও পূর্ব জার্মানির সীমানা প্রাচীর হিসেবে। সুদীর্ঘ ২৮টি বছর এই প্রাচীর দুই জার্মানিকে আলাদা করে রাখে, যা ১৯৯০ সালে আবার সবাই মিলে ভেঙে ফেলে। অর্থাৎ বার্লিন দেয়ালের পতন হয়, যা সমগ্র বিশ্বে তখন তুমুল সাড়া ফেলে। শীতল যুদ্ধ শেষে দুই জার্মানির পুনর্মিলন হয়। জার্মানরা এখন শান্তি চায়। প্রতিবেশীদের সঙ্গে চায় সদ্ভাব। বার্লিন শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়ছে স্প্রি নদী। শহরটি বেশ নিচু এবং অনেক ক্যানেল রয়েছে। তাই ব্রিজের সংখ্যাও কম নয়। ফোক্সওয়াগন মোটরগাড়ি কোম্পানির কারখানাকে ঘিরে শহরটি গড়ে উঠেছে। ঘোরাঘুরি শেষ করে প্যানেল ডিসকাশনে ফিরে এলাম।
পৃথিবী সৃষ্টির জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত ব্যক্তি বিশেষ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে দারিদ্র্য ছিল, দারিদ্র্য আছে এবং দারিদ্র্য থাকবে। আবার স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে দারিদ্র্যের ধরন একেক জনের জন্য একেক রকম। যুগে যুগে মাুনষ তার আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্যকে জয় করার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। এতে কেউ সফল হতে পেরেছেন আবার কেউ সফল হতে পারেননি।
বিশ্বে যেসব হাতেগোনা কিছু অর্থনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ কিংবা শিল্পপতি আর্থসামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে নানা মত ও তত্ত্বের ভিত্তিতে কাজ করে সফলতা অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছেন বাংলাদেশের কৃতী সন্তান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে এ দেশের পিছিয়ে পড়া সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের এক দৃঢ় স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পরই নিজ হাতে গড়ে তোলেন গ্রামীণ ব্যাংক।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, রাজনৈতিকভাবে মুক্তি পেয়ে দেশ স্বাধীন হলেও অর্থনৈতিকভাবে তখনো দেশের মানুষ মুক্ত হতে পারেনি। তাই স্বাধীন বাংলাদেশ বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখার জন্য বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তিবর্গ তাদের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করা শুরু করেন। তাদের মধ্যে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্যতম, যার হাতে গড়ে ওঠে গ্রামীণ ব্যাংক।
গ্রামের মানুষের কাছে গ্রামীণ ব্যাংক খুব জনপ্রিয় ও আস্থার জায়গা। বর্তমানে এর আড়াই হাজারেরও অধিক শাখা রয়েছে এবং সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ৫ লাখ। মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং ঋণের স্থিতি ১৭ হাজার কোটি টাকা। আদায় হার ৯৭ শতাংশ। গ্রামীণ ব্যাংকের আদলে বিশ্বের ৯৭টি দেশে এর কার্যক্রম চলছে। বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তা দেখতে, শিখতে ও জানতে বিশ্বের বহু দেশের গুণীজন, সাংবাদিক ও ছাত্রছাত্রীরা প্রায় ইউনুস সেন্টারে ভিড় করে থাকেন।
ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গ্রমীণ ব্যাংক এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং তারই ফলস্বরূপ ২০০৬ সালে নরওয়ে ভিত্তিক নোবেল কমিটি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংককে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে, যা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও স্বীকৃত। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীব্যাপী তার কৃতকর্মের জন্য সম্মানীত ও সমাদৃত।
বর্তমানে তিনি দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে নতুন একটি ধারণা ও তত্ত্ব নিয়ে সারা পৃথিবীব্যাপী কাজ করে যাচ্ছেন। আর সেটি হলো সামাজিক ব্যবসা বা সোশ্যাল বিজনেস। সামাজিক ব্যবসার এই ধারণাটি পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। আর সেই লক্ষ্য নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাতদিন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, সামাজিক ব্যবসা বা সোশ্যাল বিজনেস কী? বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে দুটি তত্ত্ব দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত। আর তা হলো পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র। নানা কারণে এখন আর সমাজতন্ত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুুতে নেই। কিন্তু সারা পৃথিবীজুড়ে পুঁজিবাদ বিরাজ করছে দোর্দণ্ড প্রতাপে। সেই পুঁজিবাদও আজ নানা কারণে সংকট ও প্রশ্নের সম্মুখীন।
এরকম বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্রঋণের উদ্ভাবক, বাংলাদেশের গর্ব, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন তার সাম্প্রতিক ‘সামাজিক ব্যবসা’ তত্ত্ব। এই ব্যবসায় বিনিয়োগকারী একটা সামাজিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিনিয়োগ করবেন, কিন্তু সেই ব্যবসা থেকে বিনিয়োগকারী কোনো ধরনের মুনাফা গ্রহণ করবেন না। শুধু বিনিয়োগের অর্থ তুলে নিতে পারবেন। মুনাফার অর্থ দিয়ে নতুন কোনো সামাজিক ব্যবসা শুরু করতে পারেন অথবা বর্তমান ব্যবসার সম্প্রসারণ করতে পারবেন। অর্থাৎ মুনাফার অর্থ পুনর্বিনিয়োগ করা যাবে, যার মাধ্যমে তৈরি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। বিশ্বব্যাপী ব্যবসায় মুনাফা বৃদ্ধির যে প্রবণতা দেখা যায়, তার বাইরে ব্যবসাকে সামাজিক কল্যাণের জন্য নিয়ে আসাই সামাজিক ব্যবসার মূলকথা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ সামাজিক ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন- ইউরোপের দেশ আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় সামাজিক ব্যবসার আওতায় বৃদ্ধ নিবাস তৈরি করা হয়েছে। ২০১২ সালে এই উদ্যোগ নেয়া হয়। বর্তমানে এই বৃদ্ধ নিবাসে ২৫০ জন বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন, যা ইতোমধ্যে একটি সফল উদ্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতে, বেকারত্ব দূর করতে সামাজিক ব্যবসা একটি কার্যকর ব্যবস্থা। বেকারত্ব এখন পুঁজিবাদের নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মতে, এই সামাজিক ব্যবসা দিয়েই বর্তমান বিশ্বের বেকারত্বের সমাধান করা সম্ভব। তরুণ-তরুণীদের স্বপ্ন ও উদ্যোগ দিয়ে বেকারত্ব দূর করতে হবে। তাইতো তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন তারুণ্য, প্রযুক্তি ও সুশাসনকে। তার মতে, ভালো চাকরি না খুঁজে উদ্যোক্তা তৈরিতে জোর দিতে হবে। তাই তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হতে হবে। কারো অধীনে নয়, বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে। এ লক্ষ্য অর্জনে সামনে থাকছে তার থ্রি জিরো তত্ত্ব। এগুলো হলো- দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ। বসবাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে হলে এগুলোকে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। তৈরি করতে হবে তিন শূন্যের পৃথিবী। অর্থাৎ শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নিঃসরণ।
ড. ইউনূস মনে করেন, পৃথিবীতে এমন পরিস্থিতি আসবে, যখন বেকারত্ব বলে কিছু থাকবে না। একজন সুস্থ শরীরের লোক বেকার থাকবে এটা হতে পারে না। তিনি তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, তোমরা ব্যবসার ধারণা নিয়ে আসো। আমরা তোমাদের সহযোগিতা করব। ড. ইউনূসের মতে, কাজের ক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমা থাকা উচিত নয়। অবসর বলে কোনো শব্দই থাকা উচিত নয়। রিটায়ারমেন্টকেই রিটায়ারমেন্টে পাঠানো হবে। তাই সামাজিক ব্যবসাকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণের মাধ্যমে মানুষকে স্বচ্ছল ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিশ্বের সব দেশ এগিয়ে আসবে, এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা।
ড. ইউসুফ খান : কলাম লেখক।