সুইস ব্যাংক সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ব্যাপক কৌতূহল রয়েছে। সুইস ব্যাংকে কারও অ্যাকাউন্ট আছে শুনলেই বিষয়টি অনেক অভিজাত বলে মনে হয়। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, সুইস ব্যাংক বলে কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংক নেই। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং নীতিমালার অধীনে পরিচালিত তিনশ’র বেশি ব্যাংক মিলেই সুইস ব্যাংক নামে অভিহিত। সুইস শব্দটি এসেছে সুইজারল্যান্ড থেকে। সুইস ব্যাংক হলো সুইজারল্যান্ডভিত্তিক একটি ব্যাংকিং সিস্টেম। মূলত গোপনীয়তা রক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য সুইস ব্যাংক সারাবিশ্বে জনপ্রিয়।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভা নগরীতে ইউনাইটেড ন্যাশনস কতৃক আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে (The Global Compact Leaders Summit) অংশগ্রহণ উপলক্ষে দেশটিকে স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয় আমার। আর তার সুবাদেই এ লেখনী। সুইজারল্যান্ড ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত একটি ছোট্ট রাষ্ট্র, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত নয়। সুইজারল্যান্ডের মুদ্রার নাম সুইস ফ্রাংক।
এটি পৃথিবীর সবচেয়ে স্থিতিশীল মুদ্রা। সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতি পৃথিবীর অন্যতম স্থিতিশীল অর্থনীতি। দেশটির রাজনৈতিক অবস্থাও খুব ভারসাম্যমূলক ও সুস্থির। সুইস সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিবছর ১ জানুয়ারিতে এর রাষ্ট্রপতি পরিবর্তিত হয়। ছয় বছরের জন্য গঠিত মন্ত্রিপরিষদের একজন মন্ত্রী পালাক্রমে এক বছরের জন্য রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
সুইজারল্যান্ড কখনো কোনো যুদ্ধে জড়ায় না। নিরপেক্ষ থাকার বিষয়েই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আর এ জন্যই রাষ্ট্রটিকে অত্যন্ত নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই ব্যাংক ব্যবস্থাও এখানে খুব নিরাপদ। গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা না থাকায় সারাবিশ্বের ধনীদের অর্থ জমানোর জনপ্রিয় উৎস হলো সুইস ব্যাংক। বিশ্বের নানা দেশের রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে বহু বিত্তশালী ব্যক্তি সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো, অনেকেই গোপনীয়ভাবে টাকা রাখতে গিয়ে তার পরিবারের কাছেও সুইস ব্যাংক বিষয়ক কোনো তথ্য দেন না। ফলে, এমন ব্যক্তির মৃত্যুর পর কেউ জানতেই পারে না যে, তার সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে। সেদেশের নিয়ম অনুসারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি কোনো উত্তরাধিকারী সম্পত্তি দাবি না করেন, তবে সুইস সরকার সে সম্পত্তি তাদের কোষাগারে জমা করেন।
ফিলিপিন্সের একসময়ের প্রভাবশালী শাসক মার্কোস তীব্র গণআন্দোলনের মুখে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ক্ষমতা ছাড়ার আগে দেশ থেকে মোটা অঙ্কের ডলার সুইস ব্যাংকে পাচার করেন। তার মৃত্যুর পর এসব ডলার সুইজারল্যান্ডের সরকারি কোষাগারে চলে যায়। একইভাবে লিবিয়ার তৎকালীন শাসক কর্নেল গাদ্দাফি ও মিসরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে।
সরকারিভাবে সুইজারল্যান্ডের অধিবাসীরা সুইস নামে পরিচিত। রাজধানী বার্ন। অন্যতম দুটি শহর হলো জেনেভা ও জুরিখ। আল্পস পর্বতমালা ও প্রশস্ত হ্রদ সুইজারল্যান্ডকে এক অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিভূষিত করেছে। বিশ্বের পর্যটকদের জন্য এটি একটি অন্যতম আকর্ষণীয় দেশ।
সুইজারল্যান্ডে সুইস ব্যাংক ছাড়াও আরেক ধরনের ব্যাংক রয়েছে, যার নাম ‘টাইম ব্যাংক’। বিশ্বের আর কোথাও এ ধরনের ব্যাংক আছে বলে আমার জানা নেই। সুইজারল্যান্ডের এ টাইম ব্যাংকিং সিস্টেম আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে। ব্লাড ব্যাংকের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন। টাইম ব্যাংক অনেকটাই ব্লাড ব্যাংকের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে। ব্লাড ব্যাংকে যেমন ব্লাড সংরক্ষণ বা জমা রাখা হয়, একইভাবে টাইম ব্যাংকেও টাইম জমা রাখা হয়।
টাইম ব্যাংক মূলত Swiss Federal Ministry of Social Security কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি অবসরকালীন ভাতা প্রকল্প (Old Age Support Programme)। এতে কমবয়সীরা কর্মক্ষম অবস্থায় নিজেদের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অসুস্থ বয়স্ক মানুষদের যতটা সময় ধরে সেবা প্রদান করেন, সেই সময়টা টাইম ব্যাংকে জমা থাকে। যেমন- বয়স্ক মানুষের জন্য বাজার ঘাট করা, ঘর দোর পরিষ্কার করা, তার জন্য পুষ্টিকর খাবার তৈরি করা, তাকে রোদে নিয়ে যাওয়া, তার সঙ্গে গল্প করা ইত্যাদি ইত্যাদি যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘Old Age Support’।
টাকা-পয়সার মতো টাইম জমিয়ে রাখার লক্ষ্যে সুইজারল্যান্ডের বেশির ভাগ মানুষ সে দেশের টাইম ব্যাংকে সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাকাউন্ট বা টাইম ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেন। এই অ্যাকাউন্টের বিপরীতে উক্ত ব্যাংক তাকে ‘টাইম ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড’ ইস্যু করেন, যা দ্বারা তিনি পরবর্তীতে বার্ধক্য সেবা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন।
সুইজারল্যান্ড ধনী দেশ। অবসরকালীন সময় তাদের পেনশনও বেশ ভালো। শেষ বয়সে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের তেমন একটা অসুবিধা হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বার্ধক্যের সময়টা তারা আরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে টাইম ব্যাংকে টাইম জমান। সেবাপ্রদানকারী ব্যক্তি যখন নিজেও বয়োবৃদ্ধ হবেন, আগের মতো নড়াচড়া করতে পারবেন না, তখন তার ক্রেডিট কার্ডের রেফারেন্স দিয়ে টাইম ব্যাংককে দরখাস্ত করলেই তাকে দেখভাল করার জন্য তারা সেবাকর্মী পাঠাবেন। সুইজারল্যান্ডে টাইম ব্যাংকিং সিস্টেম ব্যবহার করে সেখানকার বার্ধক্য সেবা প্রদান প্রকল্প বা Old Age Support Programme এক দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এতে দেশের অবসরকালীন খরচ কমার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সামাজিক সমস্যারও সমাধান হয়েছে। প্রশ্ন হলো, সুইজারল্যান্ড পারে। আমরা কবে পারব?
ড. ইউসুফ খান ।। লেখক, গবেষক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক