শিরক থেকে মুশরিক শব্দের উৎপত্তি। শিরক মানে অংশীদারিত্ব স্থাপন করা। বিশ্ব জাহানের একচ্ছত্র অধিপতি মহান আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করার নাম শিরক। মুশরিক হলো সেই ব্যক্তি যে শিরকে লিপ্ত হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করবে সেই মুশরিক। প্রতিটি মুশরিক ব্যক্তিই হলো কাফির, কিন্তু প্রতিটি কাফির ব্যক্তি মুশরিক নয়।
আল্লাহর গুণাবলীতে অন্য কাউকে সমকক্ষ স্থির করার চেয়ে বড় অপরাধ ইসলামে আর নেই। পবিত্র কোরআনে শিরককে বড় জুলুম বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলল, হে বৎস, আল্লাহর সঙ্গে শরিক করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা বড় জুলুম।’ (সুরা লুকমান: ১৩)
মহান আল্লাহ শিরককারীকে ক্ষমা করেন না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে শরিক করে। এ ছাড়া অন্য পাপ তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করল, সে অত্যন্ত গুরুতর অপবাদ আরোপ করল।’ (সুরা নিসা: ৪৮) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আর নিশ্চিত জেনো, যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম। আর যারা (এরূপ) জুলুম করে তাদের কোনো রকমের সাহায্যকারী লাভ হবে না।’ (সুরা মায়েদা: ৭২)
মানুষ যেভাবে শিরক করে
মানুষ বিভিন্ন কথা ও কাজের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে ফেলে এমন কিছু কাজ ও কথার বিবরণ এখানে তুলে ধরা হলো-
১) আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইবাদতের যোগ্য মনে করে করা। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- তোমরা দুই ইলাহ গ্রহণ করো না; তিনিই একমাত্র ইলাহ। সুতরাং তোমরা আমাকেই ভয় করো (সুরা নাহল: ৫১)। অপর আয়াতে বলা হয়েছে- আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। অতঃএব আমারই ইবাদাত করুন। (সুরা ত্বহা: ১৪)
২) মানুষকে দেখানোর জন্য কোনও ইবাদত করা। যেমন- রিয়া অর্থাৎ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদত বন্দেগি করা। সেটি হতে পারে, নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, ওয়াজ-নসিহত ইত্যাদি। রাসুল (স.) বলেছেন- আমি তোমাদের ওপর শিরকে আসগর বা ছোট শিরকের ব্যাপারে অত্যন্ত ভয় করছি। প্রশ্ন করা হলো তা কী? তিনি বললেন, তা রিয়া বা লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করা। (সহিহ আত তারগিব ওয়াত তারহিব: ৩২)
মানুষ নামাজের মধ্যে শিরক করে যেভাবে
৩) কোনও বুজুর্গ বা পীর সম্পর্কে এমন বিশ্বাস ও ধারণা রাখা যে তিনি সবসময় আমাদের অবস্থা সম্পর্কে জানেন।
৪) জোতির্বিদ, গণক, ঠাকুরদের কাছে অদৃষ্টের কথা জিজ্ঞেস করা।
৫) আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বা কিছুর নামে শপথ করা। হজরত সাঈদ ইবনে আবু উবাইদাহ (রহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এক ব্যক্তিকে এভাবে শপথ করতে শুনলেন, ‘না! এ কাবার শপথ।’ তখন ইবনে উমার (রা.) তাকে বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর নামে শপথ করল, সে শিরক করল। (সুনানে আবু দাউদ: ৩২৫১)
৬) কোনো পীর-বুজুর্গকে দূরদেশ থেকে ডাকা এবং মনে করা যে, তিনি তা শুনতে পেয়েছেন।
৭) কোনো পীর বুজুর্গ, জ্বিন-পরী বা ভূতকে লাভ-লোকসানের মালিক মনে করা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যা তিনি ইচ্ছা করেন তা ছাড়া তার জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারে না। (সুরা বাকারা: ২৫৫)। অপর আয়াতে বলা হয়েছে- তোমাদের সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে (সুরা বনি ইসরাইল: ৮৫)। নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল এবং এতদুভয়ে অবস্থিত সবকিছুর আধিপত্য মহান আল্লাহরই। তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান (সুরা মায়েদা: ১২০)
৮) কোনো পীর বুজুর্গের কবরের কাছে গিয়ে সন্তান চাওয়া।
৯) পীর বুজুর্গের কবরকে সেজদা করা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহকে ডেকো না। তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সব কিছু ধ্বংসশীল। বিধান তাঁরই এবং তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। (সুরা কাসাস: ৮৮)। অন্যত্র ইরশাদ করেন- এই যে মসজিদগুলো আল্লাহরই জন্য। সুতরাং আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে ডেকো না (সুরা জ্বিন: ১৮)
১০) কোনো পীর বুজুর্গের নামে শিরনি, সদকা বা মানত করা।
১১) আল্লাহর আদেশ ছেড়ে অন্য কারো আদেশ বা সামাজিক প্রথা পালন করা।
১২) মহররমের তাজিয়া মিছিল করা।
১৩) কোনো সময়, মুহূর্ত, দিন বা মাসকে অশুভ মনে করা। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত- রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, কোনো বস্তুকে কুলক্ষণ মনে করা ‘শিরক’, কোনো বস্তুকে কুলক্ষণ ভাবা শিরক। এ কথা তিনি তিনবার বললেন। আমাদের কারো মনে কিছু জাগা স্বাভাবিক, কিন্তু আল্লাহর ওপর ভরসা করলে তিনি তা দূর করে দেবেন (সুনানে আবু দাউদ: ৩৯১০)। আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, অশুভ লক্ষণ (বিশ্বাস করা) শিরকি কাজ। রাবি বলেন, আমাদের মধ্যে অশুভ লক্ষণের ধারণা আসে। তবে আল্লাহর ওপর ভরসার দ্বারা তা দূরীভূত হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৫৩৮)
১৪) কোনো ব্যক্তিকে সম্বোধন করে এভাবে বলা যে, উপরে খোদা নিচে আপনি।
১৫) কারো নামে কসম করা বা জিকির করা।
১৬) কোনো বুজুর্গের ছবিকে সম্মান করা বা কারো মূর্তি রাখা। (গুনাহের বিবরণ ও মুক্তির পথ, ৪-৫)
প্রতিটি মুসলমানের উচিত, যেকোনো মূল্যে শিরকমুক্ত থাকার চেষ্টা করা। অতীতে শিরক হয়ে গেলে অনুতপ্ত হয়ে মহান আল্লাহর কাছে খাঁটি তাওবা করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে শিরকি কার্যকলাপ থেকে হেফাজত করুন। তাওহিদের পথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এইচএ