স্বামী হারানোর ৪ মাস আজ। পাঞ্জাবি, টি-শার্ট আর টাওয়েলে স্বামীর ঘ্রাণ খোঁজে ফিরছেন মোছা. মারজিনা আক্তার। এক মুহূর্তের জন্যও স্বামীর মধুময় স্মৃতি ভুলতে পারছেন না তিনি। প্রতি রাত কাটছে স্বামীর পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়ে, কখনো কখনো টি-শার্ট হাতে নিয়ে অঝোরে কাঁদছেন, কখনো টাওয়েলে মুখ গুজে স্মৃতিমন্থন করছেন।
এভাবেই দিন কাটছে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ জোবায়ের আহম্মেদের স্ত্রী মোছা. মারজিনা আক্তারের। তিনি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বড়হিত ইউনিয়নের বৃ-পাচাশী গ্রামের মো. শহীদুল্লাহর মেয়ে।
বুধবার (২০ নভেম্বর) বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মারজিনা আক্তারের বিছানার এপাশ-ওপাশে স্বামীর পাঞ্জাবি-টিশার্ট আর টাওয়েল ছড়িয়ে আছে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে উপজেলার কলতাপাড়ায় ২০ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহিদ হন জোবায়ের আহম্মেদ। ২০২৩ সালের জুন মাসে জোবায়ের-মারজিনার বিয়ে হয়।
২০ জুলাই কোটাবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে আরও ২ জন শহিদ হন। তারা হলেন- ডৌহাখলা ইউনিয়নের চুড়ালী গ্রামের বাবুল মিয়ার পুত্র বিপ্লব হাসান (১৯) ও রামগোপালপুর ইউনিয়নের দামগাঁও মধ্যপাড়ার আব্দুল হালিম শেখের পুত্র নুরে আলম সিদ্দিকী রাকিব (২২)।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জোবায়ের নিয়মিত অংশ নিতেন। এ আন্দোলনে শরিক হতে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে ছুটে গেছেন ময়মনসিংহে। তবে স্ত্রীর কাছে বলতেন খেলতে যাচ্ছেন। ক্রিকেট খেলা ছিল জোবায়েরের প্রিয়।
এ প্রসঙ্গে মোছা. মারজিনা আক্তার বলেন, ২০ জুলাই সকালে খাওয়া-দাওয়া সেরে কলতাপাড়ার আন্দোলনে যেতে জোবায়ের আহম্মেদ নিত্যদিনের মতো সকালেই প্রস্তুতি নেন। বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক সেই সময় কল আসে। ওই প্রান্তে যারা ছিল, তাদের বলেছে একটু দাঁড়া বের হচ্ছি।
তিনি বলেন, যাওয়ার আগে জোবায়ের আমাকে বলেছে- দোকানে পরে যাবে, এখন খেলতে যাবে, বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তা করো না, চলে আসব। এ সময় আমার কাছে ১০০ টাকা চায়, ওরই দেওয়া ছিল। বললাম ৫০ টাকা খরচ হয়ে গেছে, আর ৫০ টাকা নিয়েই সে বেড়িয়ে যায় এ আন্দোলনে। কথাগুলো বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এক-দুই ঘণ্টার মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স আসে। দেখি এ আমার ‘জোবায়ের’। ওর নিথর দেহ দেখে, আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। হাত-পা অবশ হয়ে যায়। ৮ দিন পরে আমার জ্ঞান ফিরে। জোবায়ের, জোবায়ের বলে ডাকি, ও তো সাড়া দেয় না, কথা বলে না; এরপর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি।
তিনি আরও বলেন, বাবা বাসায় নিয়ে আসেন। তখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। হাতেও কোনো শক্তি ছিল না। অন্যের সহযোগিতায় কাপড়-চোপড় বদলাতে হতো। আমিও জোবায়েরের সঙ্গে যেতে চাই, সে তো আমাকে নিল না। একাই চলে গেল।
মারজিনার বাবা মো. শহীদুল্লাহ জানান, মেয়ের জামাই নেই; মেয়ে অসুস্থ। মেয়েকে সুস্থ করার জন্য একেকবার একেক ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছি। সে তো মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমার ২ ছেলে আর ৩ মেয়ের মধ্যে সে ৪র্থ। তাকে ভালো করার জন্য পরিবারের সবাই অস্থির হয়ে পড়ে। প্রায় ৪০ হাজার টাকা তখন ব্যয় হয়।
মারজিনার মা মোছা. মনোয়ারা খাতুন বলেন, টেলিভিশনে বা পত্রিকায় গণঅভ্যুত্থানের ছবি বা খবর দেখলেই সে হাউমাউ করে কান্না করে। জোবায়েরকে খোঁজে, তখন সে বিয়ের পাঞ্জাবি, টি-শার্ট আর টাওয়ালের গন্ধ শুকে। এমন দৃশ্য দেখলে পৃথিবীর কোনো মা স্থির থাকতে পারে না, আমিও মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছি। ওকে কী বলে সান্ত্বনা দেব। ছেলে-মেয়ের বয়স সংক্রান্ত জটিলতা থাকায় ধর্মীয়-সামাজিকভাবে ২০২৩ সালের জুনে বিয়ে হলেও বিয়ের রেজিস্ট্রি হয় চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল।
শহিদ জোবায়ের আহম্মেদের লাশ আন্দোলনকারীরা বাড়িতে ওই দিনই পৌঁছে দেয়। ছেলের জানাজায় ইমামতি করেন তার বাবা মো. আনোয়ার উদ্দিন।
জোবায়ের ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মইলাকান্দা ইউনিয়নের পূর্বকাউরাট গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোহাম্মদ আনোয়ার উদ্দিনের পুত্র। ৬ কন্যা আর ৩ পুত্র সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ৮ম। জোবায়েরের বড় বোন উম্মে হানিফ শ্যামগঞ্জ ফাজিল মাদ্রাসার কামিল পরীক্ষার্থী। সবার ছোট ভাই মো. কাউসার আহাম্মদ একই মাদ্রাসা থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী।
জোবায়ের কাউরাট আকবর আলী দাখিল মাদ্রাসা থেকে ৮ম শ্রেণি পাশ করেন। এরপর গৌরীপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। দিয়েছিলেন এসএসসি পরীক্ষা। এক বিষয়ে ক্রস থাকায় আবারও পরীক্ষা দেন। এই কারিগরি কলেজে পড়া অবস্থাতেই পুরাতন মোবাইল কেনার ব্যবসা শুরু করেন। শম্ভুগঞ্জ এলাকায় দোকান ভাড়া নিয়ে তিনি পুরাতন মোবাইল কিনে তার যন্ত্রাংশ বিক্রি করতেন। একপর্যায়ে ব্যবসার পরিধি ব্যাপকতা হলে তিনি নিজে ভারত থেকে চীন থেকে মোবাইলের যন্ত্রাংশ আমদানি এবং নতুন মোবাইল ফোন আমদানি করতেন। এছাড়াও পুরাতন মোবাইলের যন্ত্রাংশও রপ্তানি করতেন তিনি। তার আয়ে পুরো সংসারটি ঘুরে দাঁড়ায়।
এআই