শেরপুরের গারো পাহাড়ের বনাঞ্চলে বাড়ছে হাতির সংখ্যা। লোকালয়ে বাড়ছে হাতির হানা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুও। গত ৩১ অক্টোবর নালিতাবাড়ী সীমান্তে ধান ক্ষেতের পাশে দেওয়া বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে একটি বন্যহাতির মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এক দশকে শেরপুরের গারো পাহাড়ে ৩১টি হাতি প্রাণ হারিয়েছে। বেশিরভাগ হাতির মৃত্যু হয়েছে বৈদ্যুতিক ফাঁদে, নয়তো ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। এতে দেশে এশিয়ান প্রজাতির হাতির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং বিলুপ্তের পথে চলে আসছে বলে হাতি গবেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু আশার কথা হলো, শেরপুরের গারো পাহাড়ে গত এক বছরে প্রায় অর্ধশত নতুন হাতির শাবকের জন্ম হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে দিন দিন হাতির সংখ্যা বাড়ছে বলে বন বিভাগের একটি সূত্রে জানা গেছে।
সর্বশেষ গত ২২ নভেম্বর মধ্যরাতে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরি রেঞ্জ অফিসের পেছনের জঙ্গলে একটি হাতি শাবকের জন্ম হয়। এর দুই তিন মাস আগেও এই জঙ্গলে আরো কয়েকটি হাতি শাবকের জন্ম হয়েছে বলে স্থানীয় রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমন মিয়া জানান। একই সাথে নালিতাবাড়ী উপজেলার মধুটিলা রেঞ্জ এলাকায়তেও বেশ কয়েকটি হাতির শাবকের জন্ম হয়েছে বলে জানান মধুটিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম।
শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরি রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমন মিয়া জানালেন, এই রেঞ্জে বেশ কিছু এলাকায় গভীর বন থাকায় এখানে প্রায় তিনটি দলে বিরক্ত হয়ে হাতির দল বিচরণ করে আসছে। এই তিনটি দলে ৩০ থেকে ৩৫টি করে হাতি রয়েছে। সেই সাথে প্রতিটা দলে ৭ থেকে ৮টি হাতি শাবক দেখা যায়। বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) রাতে বালিজুরি রেঞ্জ অফিসের পাশেই জন্ম নেওয়া হাতি শাবক এখন সুস্থ আছে এবং দলবদ্ধ হয়ে মা হাতির সাথে বনের ভেতরে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে।
রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, মধুটিলা রেঞ্জ এলাকায় গত এক-দুই বছরে ১৫-২০টি হাতিশাবকের জন্ম হয়েছে। সব কটি সুস্থ আছে। মায়ের সঙ্গে হাতিশাবকগুলো বনাঞ্চলে নিরাপদে ঘুরেফিরে বড় হচ্ছে। আগে বৈদ্যুতিক ফাঁদ, কিংবা নানা কারণে হাতির মৃত্যু হতো, এখন তেমন আশঙ্কা নেই। বনকর্মী ও ইআরটি সদস্যরা হাতি ও শাবকগুলোকে সব সময় নজর দারিতে রাখেন।
রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমন মিয়া বলেন, সম্প্রতি আমাদের বন বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ সভায় হাতি রক্ষায় এবং জানমালের ক্ষতি এড়াতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের কারণে সাধারণ মানুষ হাতির উপর আক্রমণ থেকে বিরত থাকছে। সেই সাথে তাদের ফসল বাঁচাতেও হাতির উপর হামলা না চালিয়ে বন বিভাগের সাথে কাজ করে যাচ্ছে।
শেরপুর সীমান্ত অঞ্চলে গারো পাহাড় এলাকায় মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, বনাঞ্চল আছে এমন অন্য দেশগুলোতেও আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে আসা, খাদ্য সংকটসহ নানা কারণে হাতি আজ বিলুপ্তির ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। খাদ্যের সন্ধানে হাতি লোকালয়ে চলে আসায় বেড়েছে মানুষের সঙ্গে সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনাও।
স্থানীয় কৃষকরা তাদের ফসল বাঁচাতে জমির চারপাশে বিদ্যুতের তার দিয়ে ঘিরে রাখেন, যেন হাতির পাল এসে ফসলের ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু এতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা পড়ছে নিরীহ বন্য হাতি।
ময়মনসিংহ অঞ্চলের বন্যহাতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুর জেলার গারো পাহাড় এলাকায় ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত হাতির হামলায় ৪৩ জন প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে ময়মনসিংহ জেলায় ১০ জন, জামালপুর জেলায় তিনজন, নেত্রকোনা জেলায় পাঁচজন এবং শেরপুর জেলায় সর্বোচ্চ ২৫ জন। অপরদিকে মানুষের হামলাসহ নানা কারণে বন্যহাতি মারা গেছে জামালপুর জেলায় ৩টি, নেত্রকোনা জেলায় ২টি এবং সর্বোচ্চ শেরপুর জেলায় ২৭টি হাতি।
মানুষ মারা গেলে সরকার থেকে বন বিভাগের মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। কিন্তু হাতি মারা গেলে বা হত্যা করা হলে এতদিন কোন আইনি ব্যবস্থাপন করা হয়নি। তবে সর্বশেষ ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর শ্রীবরদী উপজেলায় এবং চলতি বছরের ১ নভেম্বর নালিতাবাড়ী উপজেলায় মাত্র দুটি হাতি হত্যার অভিযোগে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর ৩৬(১)/ ৪১ ধারা অনুযায়ী পৃথক দুটি মামলা হয়েছে।
বন্য হাতির বৃদ্ধির বিষয়ে শেরপুরের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের সদর রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আলম বলেন, শেরপুরে হাতির সংখ্যা বাড়ছে এটা নিঃসন্দেহে সঠিক তথ্য। এখানের প্রতিটি দলেই বিভিন্ন বয়সের হাতির বাচ্চা দেখা যাচ্ছে। গত দুদিন আগে আমাদের ড্রোন ক্যামেরায় বনের ভিতর ৩৪ সদস্যের একটি হাতির দলে আট থেকে ১০টি বাচ্চা দেখা গেছে। অর্থাৎ ২৪টি হাতির সঙ্গে ১০টি হাতির বাচ্চা। এটি খুবই আশার কথা।