টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে ব্যবসার উদ্দেশ্যে কিনে আনা ৯ কোটি টাকার আস্তর বালুর স্তুপ অবৈধ বালু হিসাবে জব্দ করে ভ্রাম্যমান আদালত। পরে সেই বালু ৫০ লাখ টাকায় নিলামে বিক্রি করে দেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তারিকুল ইসলাম।
গত সোমবার (৬ জানুয়ারি) উপজেলার নিকরাইল ইউনিয়নের পলশিয়া গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদুল হক মাসুদের নিজস্ব ও লিজ নেয়া জমিতে বালুর ঘাটে অভিযান পরিচালনা করেন এসিল্যান্ড। পরেরদিনই ৯ কোটি টাকার বালু মাত্র ৫০ লাখ টাকায় গোপন নিলামে স্থানীয় জহুরা ইন্টারপ্রাইজের কাছে বালু বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ও তার পরিবার।
সাবেক চেয়ারম্যানের স্ত্রী শেফালী মাসুদ বলেন, প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট আস্তর (নির্মাণকাজে ব্যবহৃত) বালুকে ২৬ লাখ ঘনফুট নিম্নমানের ভিটি বালু দেখিয়ে নিলাম দেয়া হয়েছে। যার মূল্য ধরা হয়েছে প্রতি ঘনফুট ১ টাকা ৮৫ পয়সা। অথচ প্রতি ঘনফুট বালু সিরাজগঞ্জ সরকারি বালু মহাল কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করতে হয়েছে সাড়ে তিন টাকা এবং পরিবহনসহ আনুষাঙ্গিক খরচ যোগ করে প্রতিঘন ফুট বালু দাম পড়েছে আট থেকে নয় টাকা। আর বর্তমান ভূঞাপুরের আরও ২০ টি ঘাটে এর থেকে নিম্নমানের বালু বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকা ঘনফুট। এখানে এসিল্যান্ড অসৎ উদ্দেশ্যে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।
এদিকে নিলাম কার্যক্রমের দুইদিন পরে বিষয়টি জানাজানি হলে এসিল্যান্ডের এমন কর্মকাণ্ডের ঘটনাটি আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে জেলাজুড়ে। বিপুল পরিমাণ সরকারি রাজস্ব যেমন হারিয়েছে তেমনি ভ্রাম্যমান আদালতের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ব্যক্তি মালিকানায় কেনা বালু তড়িঘড়ি করে গোপনে বিক্রি করা হয়েছে।
নিলাম আইন অনুযায়ী, নিলাম পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ এর নিদের্শক্রমে নিলাম ডাকের কমপক্ষে ৭ কার্যদিবস পূর্বে ২টি জাতীয় দৈনিক এবং ১টি স্থানীয় দৈনিকে নিলামের বিজ্ঞপ্তি প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিরাপত্তার জন্য পুলিশকে লিখিত চিঠি প্রদান ও সংশ্লিষ্ট দফতরের ওয়েবসাইটেও তা প্রকাশ করতে হবে।
শুধু তাই নয়, বিজ্ঞপ্তিতে নিলামের তারিখ, ক্যাটালগ প্রদানের তারিখ, ক্যাটালগের মূল্য, পণ্য পরিদর্শনের তারিখ-সময়, জামানতের পরিমাণ ইত্যাদি উল্লেখ থাকতে হবে। তবে, পণ্য পরিদর্শনের তারিখ নিলাম অনুষ্ঠানের কমপক্ষে ২ কার্যদিবস আগে হতে হবে। কিন্তু জব্দৃকত ওই বালু নিলামের একটি শর্তও মানা হয়নি।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় থেকে সার্ভেয়ার রফিকুল ইসলাম এবং উপজেলা প্রকৌশলী অফিসের উপ-সহকারি প্রকৌশলী আমিনুল ইসলামকে বালু ঘাটে রাখা স্তুপকৃত বালুর ধরণ ও পরিমাপের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তিনটি স্তুবে রাখা হয়েছে মোটা বালু, যা দিয়ে প্লাস্টার কাজে ব্যবহার করা হয়। স্থানীয়দের মাধ্যমে বালু মেপে দেখা যায়, সেখানে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ ঘনফুট বালু রয়েছে। সিরাজগঞ্জের মেসার্স এস কন্সট্রাকশন থেকে এই বালু কেনা হয়েছে এমন অসংখ্য রশিদ উপস্থাপন করেন ক্রেতারা।
নিকরাইলের পলশিয়া গ্রামের আলাউদ্দিন বলেন, কয়েকমাস আগেই সিরাজগঞ্জ মহাল থেকে বালু কিনে এনে চেয়ারম্যান তার নিজের জায়গায় ও অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে ফেলেছেন। প্রতি সিএফটি বালু কেনা পড়েছে ৮টাকা। বর্তমানে বিভিন্ন ঘাটে প্রতি সিএফটি বালু বিক্রি হচ্ছে ১২টাকায়। অথচ এসিল্যান্ড এর দাম ধরেছেন ১ টাকা ৮৫ পয়সা।
বালু নিলামের জন্য এলাকায় কোনো মাইকিং করা হয়েছিল কিনা এ ব্যাপারে পলশিয়া এলাকার নূরুল ইসলাম বলেন, আমরা সার্বক্ষণিক এলাকায় থাকি। কোনো মাইকিং করা হলে কেউ না কেউ শুনতো। এছাড়া কোনো পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে সেটিও জানা যেতো। এমনি এসিল্যান্ডের অফিসে বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে রাখলেও জানা যেত। ঘটনাস্থলেও কোন নিলামের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় নাই। বিষয়টি পরিকল্পিতভাবে ও গোপনে করা হয়েছে।
উপজেলা সহকারী (ভূমি) অফিসের সার্ভেয়ার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, তিনটি বালু স্তুপের মধ্যে একটি স্তুপের বালু পা দিয়ে পরিমাপ করেছি। অন্য দুটি শুধু দেখেছি। এতে আনুমানিক সবমিলিয়ে ২৬ লাখ ঘনফুট নির্ধারণ করেছি। অন্যান্য বিষয় এসিল্যান্ড স্যার জানেন। যদিও একদিন পরেই তার বক্তব্য পরিবর্তন করেন সার্ভেয়ার। এসময় তিনি জানান, ফিতা ও চেইন টেনে তিনি বালু পরিমাপ করেছেন। এ কাজে তাকে আরও দুইজন সহায়তা করেছে। তবে তিনটি বালুর স্তুপের কোনটিতেই মাপামাপি হয়নি বলে জোড়ালো দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
বালু পরীক্ষা করা উপজেলা প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম বলেন, ভূমি অফিস থেকে আমাকে বালুর ধরণ সম্পর্কে জানাতে বলা হয়েছিল। পরে আমার দফতরের লোক পাঠালে সে নমুনা নিয়ে আসে। চোখে নমুনা দেখে ভিটি বালু মনে হয়েছে। আমি সেটি বলে দিয়েছি।
ভূঞাপুর থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) একেএম রেজাইল করিম বলেন, কবে কোথায় কিভাবে বালু নিলাম হয়েছে তা জানা নেই। তাছাড়া নিলাম অনুষ্ঠানের মৌখিক বা লিখিত কোনো চিঠি পাইনি।
উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, ভ্রাম্যমান আদালত আইন অনুযায়ী বালু জব্দ করে নিলাম দেয়া হয়েছে। নিষিদ্ধ বাল্কহেডের মাধ্যমে বালু পরিবহন করে সেখানে স্তুপ করে রাখা হয়েছিল তাই এটি অবৈধ। প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ব্যক্তি জমিতে মজুদ অবৈধ। তাই এটিও অবৈধ। এছাড়া বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন মোতাবেক জন দুর্ভোগ পরিবেশ সৃষ্টি করায় এটি অবৈধ। কোন ব্যক্তির জমিতে বালু রাখলেও প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন। সুতরাং আইনের ব্যত্যয় হওয়ায় ভ্রাম্যমান আদালদ পরিচালনা করে বালু মেপে তারপর নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেম, বালু আইনের বিধি মোতাবেক তিনি নিলাম করেছেন। যদি সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হন তাহলে তিনি আপিল করতে পারবেন। সেই সুযোগ তার রয়েছে। এছাড়া এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তে ক্ষমতার অপব্যবহার ও কারও দোষ প্রমাণ হলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এমআর