কোকিল, টিয়া, ঘুঘু, ময়না, দুয়েলসহ ২৫ ধরণের পাখির ডাক জানেন জয়নাল আবেদীন পাখি। সেই সাথে যেকোন গানের মিউজিক মুখে বাজাতে পারেন। তিনি সবার কাছে আবেদীন পাখি নামে পরিচিত। তাই চেনা অচেনা সবাই তাকে পাখি ভাই বলে ডাকেন। আবাল বৃদ্ধ বণিতা এমনকি শিশু কিশোরেরা তার পাখির ডাকে বিমোহিত হয়। তাই পাখি ভাই সবার কাছে অতি পছন্দের মানুষ। তাই তার মুখে পাখির নানা ডাক ও সুরে কিছু করে দেখানোর জন্য আবদার করেন।
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার চৌগাংগা ইউনিয়নের কিষ্টপুর গ্রামের মৃত মনজিল মুন্সির ছেলে জয়নাল আবেদীন পাখি (৫৪) পেশায় তিনি একজন কৃষক। হাসিখুশি জয়নাল আবেদীন পাখি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েন গ্রামের মেঠোপথে কৃষকের কাজ করতে গিয়ে শিশু-কিশোরসহ সকল বয়সের মানুষদের নানাভাবে আনন্দদেন তিনি। এজন্য এলাকায় পাখি জয়নাল হিসেবে পরিচিত তিনি। এমনকি এলাকার নানা অনুষ্ঠানেও তাঁর এই ডাক শুনতে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
উপজেলার চৌগাংগা ইউনিয়নের কিষ্টপুর কিছুদুর গেলেই ছোট একটি টিনের ঘর। এই খুপড়ি ঘরেই পরিবার নিয়ে বাস করেন প্রতিভাবান জয়নাল আবেদীন পাখি। ছোট থেকেই পরিশ্রমি জয়নাল আবেদীন পাখি। কৃষি কাজে যা রোজগার হয়, তা দিয়েই চলে পাঁচ সদস্যের সংসার। দারিদ্র্যতা পিছু না ছাড়লেও স্ত্রী, তিন সন্তানকে নিয়ে সুখি তিনি। অস্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করার পরে অভাবে ঝড়ে পড়ে তাঁর শিক্ষাজীবন। বাবা মৃত মনজিল মুন্সির সঙ্গে মাঠে কাজ করতে গিয়েই পশু-পাখির ডাক শুনে রপ্ত করেন তিনি। নিজে পড়ালেখা করতে না পারলেও সন্তানদের পড়াচ্ছেন তিনি। জয়নাল আবেদীন শুধু শিশুদের কাছে আনন্দের মানুষ, এমন নয়। চায়ের দোকান কিংবা বাজারে তাঁকে দেখলে মানুষ ঘিরে ধরেন। তাঁর সঙ্গে কৌতুক আর খোশ গল্পে মেতে উঠেন। জয়নাল আবেদীন পাখি যেমন পরিশ্রমি, তেমনি প্রতিভাবানও। তাঁর প্রসংশায় মুগ্ধ এলাকার মানুষ। যত দিন বেঁচে আছেন, ততদিনই মানুষকে আনন্দ দিয়ে যেতে চান প্রতিভাবন জয়নাল আবেদীন পাখি। এই বয়সে সে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অথবা পশু-পাখির খামার করে ভাল থাকতে চান। কিন্তু অর্থাভাবে এসব কিছুই তাঁর কাছে স্বপ্ন। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকারের কাছে সহযোগতা চান জয়নাল আবেদীন পাখি।
সরেজমিনে ইটনা উপজেলার চৌগাংগা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, জয়নাল আবেদীন পাখির সঙ্গে কৌতুক আর খোশ গল্পে মেতে উঠেছেন সবাই। সবাই জয়নাল আবেদীন পাখির কাছে বিভিন্ন পাখির ডাক শোনার আবদার করছে। তিনিও তাদের কথামতো শুনিয়ে যাচ্ছে ময়না, টিয়া, ঘুঘুসহ বিভিন্ন পাখির ডাক। জয়নাল আবেদীন পাখি আর সবার উচ্ছ্বাসে তৈরি হয়েছে এক আনন্দঘন পরিবেশ।
স্থানীয় এলার বাসিন্দা রাসেল মিয়া বলেন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন জয়নাল আবেদীন পাখি চাচার কাছে নানা আবদার করতাম। জয়নাল আবেদীন পাখি একজন কৃষক হলেও তাঁকে ঘিরে মানুষের আগ্রহ অনেক। তাঁর প্রতিভা সবাইকে মুগ্ধ করে। সরকার যদি তাকে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অথবা পশু-পাখির খামার করে দিত তাহলে অনেক ভালো হতো।
জয়নাল আবেদীন পাখির প্রতিবেশী কামাল হোসেন বলেন, জয়নাল আবেদীন পাখি একজন কৃষক। আমার প্রতিবেশী। তাকে প্রায়ই দেখি মাঠে কাজ করতে, আবার বাজারে বসে পাখির ডাক শোনাতে। অবিকল যেকোন পাখির ডাক সে ডাকতে পারে। তিনি আমাদের গ্রামের গর্ব অত্যন্ত সৎ ও ভালো মনের একজন মানুষ। তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ, তাকে সবাই সহযোগিতা করলে এই বয়সে সে একটু ভালো থাকতে পারতো।
জয়নাল আবেদীন পাখির স্ত্রী মোছা. রেখা আক্তার বলেন, বিয়ের আগে থেকেই আমার স্বামী পাখির ডাক ডাকতে পারেন। আমাকে যখন প্রথম দেখতে যান, তখনও তিনি কোকিলের ডাক ডেকেছিলেন। ওনি একজন ভালো মানুষ, সারাজীবন ওনার সঙ্গেই কাটাতে চাই। স্বামীর আয় কম, কিন্তু মনটা অনেক বড়। আমাদের ভালো একটি বসতঘর নেই। কোন রকমের চারপাশে টিনের বেড়া দিয়ে দিয়ে তিন সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছি। এক ছেলে প্রতিবন্ধী। যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে আমাদের সংসার।
১০নং চৌগাংগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বলেন, জয়নাল আবেদীন একজন সাধারণ কৃষক ও সাংস্কৃতিক মনা একজন মানুষ। তার এই প্রতিভার মাধ্যমে এলাকায় ও এলাকার বাহিরে বেশ পরিচিতি ও শুনাম অর্জন করেছে। তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক খারাপ, সরকার যদি তাঁকে সহযোগিতা করতো তাহলে সে একটু ঘুরে দাঁড়াতে পারতো।
জয়নাল আবেদীন পাখি জানান, ছোটবেলা থেকেই কোনো পাখির ডাক শুনলে মনে গেঁথে যেত। পরে একটি-দুটি করে পাখির ডাক আয়ত্ব করতে করতে এখন প্রায় ২৫টি পাখির ডাকসহ বিভিন্ন মিউজিক রপ্ত করেছেন এবং বলতে ও গাইতে পারেন কবিতা ও গান। কৃষি কাজের পাশাপাশি শিশু-কিশোরসহ সকল বয়সের মানুষ আমারে দেখলেই কাছে আসে। আবদার করে। আমিও তাদের মজা দেওয়ার চেষ্টা করি। তার এমন প্রতিভা দেখা ও শুনার জন্য দূর দূরান্ত থেকে প্রতিদিনেই ছুটে আসেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। আর এসব কারণেই তিনি জয়নাল আবেদীন পাখি নামে পরিচিত। তিনি আরও জানান, সরকার যদি আমাকে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অথবা পশু-পাখির খামার করে দিতো তাহলে আমি তিন সন্তানকে নিয়ে চলতে পারতাম।
পিএম