আব্দুল হান্নান মিয়াজী ২৫ বছরের এক তরুণ। সে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের কেদারখীল গ্রামের আবু সালেকের পুত্র। সে ইউটিউব ও ফেসবুকে বিনিয়োগের কথা বলে মাসে প্রতি লাখ টাকায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার লভ্যাংশের প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন শত কোটি টাকা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে লাভ তো দূরের কথা, মূলধন নিয়ে উধাও হয়ে যায় সে। এদিকে বিনিয়োগকারীরা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে তাকে। শতশত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একজন হল নুর ইসলাম। সে বিনিয়োগ করেছিল অধিক লাভের আশায় এক কোটি ৮৪ লক্ষ টাকা। বিনিয়োগ করা তার এই টাকা ছিল নিজেরসহ আত্মীয়-স্বজনের। কিন্তু গা ঢাকা দেওয়ায় বিচলিত হয়ে পড়েন তিনি।
একপর্যায়ে তিনি তার বিরুদ্ধে সীতাকুণ্ড থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশের একটি টিম বড় দারোগারহাট এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করেন। এদিকে তার গ্রেফতারের খবর শুনে শত শত বিনিয়োগকারী থানার সামনে এসে জড়ো হয়। তাদেরও অভিযোগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন সীতাকুণ্ড মডেল থানার ওসি মজিবুর রহমান।
স্থানীয়দের দাবি, এই প্রতারক চক্রের মূল হান্নান মিয়াজী নয়, তার সাথে রয়েছে আরো বেশ কয়েকজন। পরবর্তীতে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে তাদের নাম।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হান্নান মিয়াজী নিজেকে একজন ফ্রিল্যান্সার দাবি করে। এলাকায় সবাই তাকে ফ্রিল্যান্সার হান্নান হিসেবেই চিনে। কয়েক বছর আগে হঠাৎ ফ্রিল্যান্সিংয়ের ব্যবসার কথা বলে ইউটিউব ও ফেসবুকে বিনিয়োগের চুক্তিতে প্রতি লাখে মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভে বিনিয়োগ করেছে সাধারণ মানুষ। প্রথম পর্যায়ে চুক্তিপত্র অনুযায়ী লাভের অংশ সময়মতো পরিশোধ করায় এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তারপর থেকে এই লোভনীয় বিনিয়োগের সুযোগ পেতে রীতিমতো হামাগুড়ি দিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করেছে শত শত মানুষ। এই বিনিয়োগ করতে কেউ বিক্রি করছে ঘরের ভিটা, কেউ ভাঙছে ব্যাংকের ফিক্স ডিপোজিট, অনেকে নিয়েছে বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে ঋণ। অনেকে বিনিয়োগ করেছে জীবনের বেঁচে থাকার জমানো শেষ অর্থকড়ি।
বিনিয়োগকারীদের ধারণা, যেখানে বিভিন্ন ব্যাংক কিংবা এনজিও সংস্থা থেকে ঋণ নিলে বছরে প্রতি লাখে লাভ দিতে হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা, সেখানে হান্নান মিয়াজী লাখে মাসে লাভ দিচ্ছেন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এ যেন ফ্রিল্যান্সার হান্নান মিয়াজীর ঘরে আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতই। সে এই ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য প্রায় শতাধিক প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে। সেই প্রতিনিধিরা সাধারণ মানুষ থেকে এনে দিচ্ছেন টাকা। সেই টাকার উপর বিনিয়োগকারীরা প্রতিমাসে ১৫-২০ হাজার টাকা লাভের পাশাপাশি প্রতিনিধিরাও পাচ্ছে একটি মোটা অংকের কমিশন। হান্নান মিয়াজীর শতাধিক প্রতিনিধির মধ্যে একজন হল নূর খান শিহাব। সে প্রায় ৯৫ জন বিনিয়োগকারী থেকে প্রায় তিন কোটি টাকার মতো হাতিয়েছেন। একইভাবে অন্য প্রতিনিধিরাও মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
পরিচয় না বলার শর্তে এক নারী বলেন, অভাবের সংসার, স্বামী বেকার, এক ছেলে ও এক মেয়ে। তার মধ্যে ছেলে প্রতিবন্ধী। কোনভাবে সেলাই কাজ করে পেট চলে। কিন্তু হান্নান মিয়াজী আমাকে অধিক লাভের কথা বলে বিনিয়োগের কথা বলেন। আমার নিজের কাছে কোন টাকা পয়সা ছিল না। অধিক লোভে ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাকে চার লক্ষ টাকা দিয়ে এখন আমি পাগলের মত ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিভাবে শোধ করবো এতগুলো টাকা? কিভাবে চলবে সংসার? এখন আমার মরা ছাড়া কোন উপায় নেই।
নাম প্রকাশ না করে সত্যিই এক বিনিয়োগকারী বলেন, প্রায় ৫৫৭ জন বিনিয়োগকারী শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে হান্নান মিয়াজীর কাছে। অধিক লাভের আশায় অধিকাংশ বিনিয়োগকারী ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছে।
ইলিয়াস নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, আমি আব্দুল হান্নান মিয়াজীর অফিসে চাকরি করতাম। যার কারণে আমিও আত্মীয়-স্বজন থেকে নিয়ে প্রায় ২৫ লাখ টাকার মত বিনিয়োগ করেছি। প্রথম দুমাস চুক্তিপত্র অনুযায়ী লাভ দিলেও দীর্ঘ সাত-আট মাস ধরে কোন লাভ দিচ্ছে না।
এদিকে ফ্রিল্যান্সার হান্নান মিয়াজী চুক্তিপত্র অনুযায়ী বিনিয়োগকারীদেরকে ৭ থেকে ৮ মাস ধরে কোন লাভ দিচ্ছে না। যার কারণে বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন তার বাড়িতে এসে ভিড় জমাচ্ছেন। যার কারণে তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। পুরো উপজেলার মধ্যেই মুচি থেকে মুদির দোকানে সর্বমহলে একটি কথা, কিভাবে সম্ভব এত লাভ?
হান্নান মিয়াজীর স্ত্রী সুমাইয়া বলেন, সে অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ব্যবসা করে শুনেছিলাম। যার কারণে সে ব্যবসার জন্য অনেক মানুষ থেকে টাকা নিয়েছে। কিন্তু সে এই টাকা কি করেছে আমি কিছুই জানি না। কিছুদিন আগে আমাকে মুঠোফোনে বলেছিল, সে তার ফুফাতো ভাই বেলালের কাছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা রেখেছেন। কিন্তু বেলালের সাথে এ বিষয়ে কথা বললে তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, সে বাংলাদেশের আলিফ হাসান ও পাকিস্তানের আলী রেজা নামের দুই ব্যক্তির মাধ্যমে একটি সফটওয়্যারে বিনিয়োগ করেছে শুনেছিলাম। আমার কাছে ওর কোন টাকা নাই। তদন্ত হলে সেটা বুঝা যাবে।
সীতাকুণ্ড মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মজিবুর রহমান বলেন, নুরুল ইসলাম নামের এক ভুক্তভোগীর অভিযোগে হান্নান মিয়াজীকে গ্রেফতার করা হয়। সে ব্যবসার কথা বলে প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে দিয়েছে সাধারণ জনগণ থেকে। তার গ্রেপ্তারের শুনে শত শত মানুষ জড়ো হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে বলে জানা গেছে। তাকে বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। এই ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: ফখরুল ইসলাম বলেন, হান্নান মিয়াজী নামক এক প্রতারককে গ্রেফতার করেছে বলে শুনেছি। উনি তো কোনো সংস্থা না। তার কাছে এভাবে টাকা বিনিয়োগ করা উচিত হয়নি। এখন যখন তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এসআর