রাত তখন সাড়ে ১২টা। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বাতকুচি টিলাপাড়া গ্রামে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা ছুরতন নেছা প্রতিদিনের মতোই একাকি ঘুমাচ্ছিলেন তাঁর টিনের ঘরে। ওইদিন গভীর রাতে বাতকুচি টিলাপাড়া ও পলাশিকুড়া এলাকায় তাণ্ডব চালায় একদল বন্যহাতি। হইহুল্লোড়, ডাক-চিৎকার করেও হাতিগুলোকে সরাতে পারেননি গ্রামবাসী। গ্রামবাসীর বাঁধা উপেক্ষা করে সদলবলে ঢুকে পড়ে বন্যহাতি।
এ অবস্থায় ৪৫-৫০টি বন্যহাতির দলটি বাতকুচি টিলাপাড়া তাণ্ডব চালায়। গ্রামের ৭-৮টি বসতঘর ভেঙে গুড়িয়ে তছনছ করে দেয়। ঘরে রাখা ধান, চাল ও গাছের কাঁঠাল এবং কলাগাছ খেয়ে সাবাড় করে হাতির দল। উপায় না পেয়ে স্থানীয়রা গ্রামের শিশু, নারী ও বয়োবৃদ্ধদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে পারলেও স্বামীহারা বৃদ্ধা ছুরতন নেছার খোঁজ রাখেনি কেউ। একপর্যায়ে হাতির পাল ছুরতন নেছার ঘরে হানা দিয়ে তাকে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে বাইরে এনে পায়ে পিষ্ট করে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঘটনাটি গত ২৯ মে ঘটলেও এখনও আতঙ্ক যাচ্ছে না ছুরতন নেছার পরিবারের।
ছুরতন নেছার মেয়ে রহিমা খাতুন বলেন, 'হাতির পাল চলে গেলে বাড়ি এসে দেখি মায়ের থাকার ছোট ঘরটা তছনছ হয়ে গেছে। ঘরের পাশে মায়ের ছিন্নভিন্ন দেহটা পড়ে আছে। ঘরের চালার টিনগুলো খুলে সরিয়ে রেখেছি। এখন অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাকছি। একটা ঘর উঠাবো সে উপায়ও নাই।' কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, 'আপনাদের কাছে হাতির জীবনের দাম আছে, আমগর জীবনের কি দাম নাই। হাতির অত্যাচারে আমগর এখন মরণ দশা।'
ছুরতন নেছা (৬৫) একা নন, তাঁর মতো অনেক কৃষকই হাতি তাড়াতে গিয়ে নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
শেরপুরের গারো পাহাড়ে বন্যহাতির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব থেমে নেই। বন বিভাগ বারবার নিরুৎসাহিত করলেও এসব কর্মকাণ্ড ঘটেই চলেছে। আবার আত্মরক্ষার্থে অনেক সময় অবধারিতভাবেই মানুষ কিংবা হাতির প্রাণ যাচ্ছে। পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান করা হাতির সঙ্গে স্থানীয়দের 'দ্বন্দ্ব' হয়ে উঠেছে নিয়মিত ঘটনা। শুধু ফসলহানি নয়, গত কয়েক বছর ধরে হাতির আক্রমণে প্রাণহানিও নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এতে অতিষ্ঠ ও ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ হাতি সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে ফুঁসে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ মঙ্গলবার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হবে বিশ্ব হাতি দিবস। তবে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে দিবসটি পালনে বিশেষ কোনো কার্যক্রম নেই।
বন বিভাগের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে গারো পাহাড়ে ৩৫টি বন্যহাতি ও একই সময়ে ৩৬ জন মানুষ মারা গেছে। এর মধ্যে গত ৮ মাসে ৫টি হাতি ও ৪ জন মানুষ মারা যায়। বেশির ভাগ হাতিকে বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। হাতি হত্যার ঘটনায় বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে কয়েকটি মামলাও হয়েছে।
দিনে দিনে বনাঞ্চলে মানুষের দখলদারিত্ব ও তথাকথিত 'উন্নয়নের' ফলে সংকুচিত হয়ে আসছে বিশালদেহী বন্যপ্রাণী হাতির চলাচলের পথ। নিজের বিচরণভূমির সংকোচন, বনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে উদ্ভিজ্জসহ খাদ্য সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে হরহামেশাই লোকালয়ে চলে আসছে এ প্রাণীটি। এদিকে জনবসতি, ঘরবাড়ি, কৃষিজমি ও গাছপালা 'বিনষ্টের' দায়ে মানুষই নির্বিচারে হাতি হত্যা করছে। এমনকি বৈদ্যুতিক শক দিয়েও মারা হয়েছে সংকটাপন্ন অবস্থায় থাকা এই বন্যপ্রাণীগুলোকে।
বিলুপ্তির শঙ্কার মধ্যে 'বাড়ছে' হাতির সংখ্যা:
বন বিভাগ ও স্থানীয়দের তথ্যমতে, ১৯৯৫ সালে ২০-২৫টি বন্যহাতির দল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পিক পাহাড় থেকে দলছুট হয়ে গারো পাহাড়ে চলে আসে। পরে এসব হাতির পাল ভারতের কাঁটাতারের বেড়া ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বাধার কারণে আবাসস্থলে ফিরে যেতে পারেনি।
এরপর ২০০৯-১০ সাল থেকে গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। ওই সময় থেকে গারো পাহাড়ের সীমান্ত এলাকায় হাতি খাবারের সন্ধানে ফসলের মাঠ ও ঘরবাড়িতে প্রবেশ শুরু করে। সেই সময় হাতি তিনটি-চারটি দলে বিভক্ত ছিল। একেকটি দলে ১৫-২০টি করে হাতি দেখা যেত। সেই হিসাবে বনকর্মীরা ৭০-৭৫টি হাতি থাকার তথ্য দিতেন। গত ১৪-১৫ বছরে ওই সব হাতির মধ্যে বিভিন্নভাবে মারা গেছে ৩০টির বেশি। এ হিসাবে হাতির সংখ্যা ৪০-৪৫টির বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ের সব এলাকায় ১২০-১৩০টির মতো হাতি দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
শেরপুর বন বিভাগের ওয়াইল্ডলাইফ রেঞ্জার আব্দুল্লাহ আল আমিনের ভাষ্য, 'ড্রোন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, গারো পাহাড়ে তিনটি দলে আনুমানিক ১২০ থেকে ১৩০টি হাতি গারো পাহাড়ে বিচরণ করছে। এর মধ্যে এক থেকে দুই বছর বয়সী বেশ কিছু শাবককে তারা পাহাড়ে মা হাতির সঙ্গে খাবার খেতে দেখেছেন। যেহেতু হাতির হোমরেঞ্জ অনেক বড়, তাই জরিপ ছাড়া সঠিক সংখ্যা তারা নির্ধারণ করতে পারেননি।'
হাতি রক্ষায় বন বিভাগের উদ্যোগ:
বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, হাতির দলকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পাহাড়ী অঞ্চলে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) সদস্যদের সঙ্গে বন বিভাগ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে, স্থানীয়রা বলছেন, হাতির দলের তাণ্ডবে তারা সবসময় আতঙ্কে থাকেন। ধান ও কলা গাছসহ খাবারের খোঁজে প্রায় রাতেই হানা দেয় হাতি।
মধুটিলা ইকোপার্কের রেঞ্জ কর্মকর্তা দেওয়ান আলী বলেন, 'আগে এ এলাকায় হাতিগুলো নিয়মিত যাতায়াত করত, কিছুদিন থেকে আবার চলে যেত, কিন্তু কয়েক বছর ধরে সেগুলো সেখানে স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করেছে। যার কারণে এখন হাতি আসা-যাওয়া করলেই কারো ফসলি জমি আবার কারো ঘরবাড়ি ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা বন বিভাগের নির্ধারিত ফরমে আবেদন করে সরকারিভাবে ফসলের ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন। হাতি আক্রান্ত এলাকায় আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর নিচ্ছি।'
ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, 'গারো পাহাড়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পরিচালন ব্যয় খাতের আওতায় ১৮০ হেক্টর জমিতে বন বিভাগ হাতিসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর খাদ্য নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হচ্ছে 'খাদ্য বাগান'। যেখানে রোপণ করা হচ্ছে ৬০ প্রজাতির ফলদ ও বনজ গাছের চারা। এসব ফলদ ও বনজ গাছের মাধ্যমে বন্যপ্রাণীর খাদ্য নিশ্চিত করা ছাড়াও তাদের নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি হবে। হাতি মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে ৫৩টি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়াও মানুষ এবং বন্য হাতি সহাবস্থানে রাখতে সচেতনতাসহ নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছি।'
বিশেষজ্ঞদের মত:
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, 'মানুষ-হাতির এ দ্বন্দ্ব আসলে হয়ে থাকে ফসলের মৌসুমে, বিশেষ করে ধানের মৌসুমে। ধান খাওয়ার উদ্দেশ্যে যখন হাতিরা খেতে হানা দেয়, তখন নিজেদের ফসল বাঁচাতে মানুষও মরিয়া হয়ে যায়। আগে আগুন জ্বালিয়ে কিংবা বর্শা দিয়ে হাতিকে আক্রমণ করে তাড়ানোর চেষ্টা করতেন স্থানীয়রা। তবে কয়েক বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে হাতি মারার কৌশল। ফসলের খেতের পাশে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুতের তার দিয়ে ফাঁদ পেতে রাখা হয়, আর হাতিগুলো বিদ্যুতের সংস্পর্শে এসে মারা পড়ছে। আইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বন বিভাগের উচিত, হাতি তাড়ানোর এসব বৈদ্যুতিক উপায় কঠোর হাতে দমন করা।'
ড. মনিরুল বলেন, 'যেকোনো মূল্যে হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে সরকারি জমি, অর্থাৎ বন বিভাগের জমির ভেতরে যেন কোনোপ্রকার কৃষিকাজ না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।'
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. রেজা আলী খান বলেন, 'হাতিকে পাহাড়ে রাখার পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে কিংবা তার চাহিদা মেটাতে না পারলে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের পাহাড়ের নিকটবর্তী আরও বিভিন্ন এলাকা আক্রান্ত হবে, যেখানে অতীতে কখনো হাতির বিচরণ দেখা যায়নি। সরকারি খাস জমি বা বন বিভাগের জমি দখল বিরোধী আইন প্রয়োগ করে হাতির আবাস্থলে অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করতে হবে। হাতির চলাচল ও পরিযানের পথগুলো চিহ্নিত করে আইনত সুরক্ষিত করতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বন ও প্রাণী রক্ষার সব সংস্থার দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা এবং কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক বন ও প্রাণী রক্ষায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
এসআর