চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেল নিয়ে স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। চীনের সাংহাইয়ের আদলে চট্টগ্রামকে 'ওয়ান সিটি টু টাউন' হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল এই প্রকল্প। দক্ষিণ চট্টগ্রামকে শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করে শিল্পায়ন, পর্যটন, বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, উদ্বোধনের এক বছরের মাথায় প্রতিদিন ১৮,৪৮৫টি গাড়ি টানেল ব্যবহার করবে। তবে ২০২৪ সাল পার হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, প্রতিদিন গড়ে মাত্র ৩,৯১০টি গাড়ি টানেল দিয়ে যাতায়াত করছে। এই সংখ্যা প্রত্যাশিত মাত্রার এক চতুর্থাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও কৌশলগত পরিকল্পনার অভাবে এই প্রকল্প এখন পর্যন্ত তার প্রত্যাশিত লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে।
১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে চীনের অর্থায়নে নির্মিত এই টানেলটি চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (CCCC) নির্মাণ করেছে। এর মধ্যে ৬,৭৪৬ কোটি টাকা চীনের ঋণ। কর্ণফুলীর দুই পাড় পতেঙ্গা ও আনোয়ারাকে সংযুক্ত করা এই টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার, যার মধ্যে মূল টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার।
টানেলের দুটি টিউব দিয়ে একমুখী গাড়ি চলাচল করে। ৩৫.৪ ফুট চওড়া ও ১৬ ফুট উচ্চতার এই টানেল দিয়ে প্রাথমিকভাবে দিনে ১৮,০০০ এর বেশি গাড়ি চলবে বলে আশা করা হয়েছিল। এর ফলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমে যাবে এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে এটি এশিয়ান হাইওয়ের সংযোগ তৈরি করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল।
টানেলের চালু হওয়ার পর থেকেই প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে বাস্তব চিত্রের ফারাক স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সমীক্ষা অনুযায়ী বছরে প্রায় ৭৬ লাখ গাড়ি টানেল ব্যবহার করবে বলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর উদ্বোধনের পর এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, এখন পর্যন্ত টানেল ব্যবহার করেছে মাত্র ১৫ লাখ গাড়ি।
টানেলে চলাচলকারী যানবাহনের মধ্যে ৭৭% ছিল প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাস, ১০% বাস এবং ১২% ট্রাক। ফলে ভারী যানবাহনের অংশগ্রহণ কম থাকায় টোল আদায়ের পরিমাণও প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম।
প্রতিদিন সাড়ে ১০ লাখ টাকা টোল আদায় হলেও টানেল পরিচালনায় প্রতিদিন ব্যয় হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। ফলে প্রতিদিনই বড় অঙ্কের অর্থ লোকসানে যাচ্ছে। এক বছরে ৩৮ কোটি টাকার বেশি টোল আদায় হলেও, পরিচালন ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩৭ কোটি টাকা। বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিল্পায়ন, বাণিজ্যিক অঞ্চল ও আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা। কিন্তু এখন পর্যন্ত আনোয়ারা, পটিয়া বা বাঁশখালীতে উল্লেখযোগ্য কোনো নগরায়ন বা শিল্পায়ন হয়নি। ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ টানেল ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না।
টানেলের ব্যবহার সীমিত থাকার অন্যতম কারণ হলো, একই গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য বিকল্প পথের সহজলভ্যতা। শাহ আমানত সেতু দিয়ে সহজেই আনোয়ারা বা পটিয়া যাওয়া যায়, যেখানে অতিরিক্ত টোল দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ফলে পরিবহন খাতের অনেকেই টানেলের পরিবর্তে সেতু ব্যবহার করছেন।
টানেল পরিচালনার জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, কৃত্রিম অক্সিজেন সরবরাহ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও টোল আদায়ে দৈনিক খরচ অনেক বেশি। পাশাপাশি টানেলের বিভিন্ন খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে, যা ব্যয় আরও বাড়িয়ে তুলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্ণফুলী টানেল একটি যুগান্তকারী প্রকল্প হলেও, সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাবে এখন পর্যন্ত প্রত্যাশিত ফলাফল দিতে পারেনি। উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কার্যকর নীতির মাধ্যমে এই অবকাঠামো প্রকল্পকে লাভজনক ও কার্যকর করা সম্ভব। নতুবা, এটি একসময় রাষ্ট্রের জন্য বিরাট আর্থিক বোঝায় পরিণত হতে পারে।
সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক উদ্যোগ নেওয়া হলে এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বাস্তবায়িত হলে কর্ণফুলী টানেল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। নতুবা এটি বিশাল ব্যয়ে নির্মিত একটি অপূর্ণ স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে।
এসআর