ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে শীত মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে মৃত্যুপুরী হিসেবে পরিণত হয়েছে। এতে প্রতিদিন ছোট বড় দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হচ্ছে মানুষ। এ কারণ হচ্ছে ঘনকুয়াশা এবং চালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর ফলে এ দুর্ঘটনা ঘটছে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে গত বছরে ২২ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ৬৪টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৮৫জন আহত হয়েছেন।মারা গেছেন ১০ জন নারীসহ মোট ২২ জন। যার মধ্যে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই মারা গেছে ১০ জন।
শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলার নিমতলা থেকে শুরু করে শ্রীনগর উপজেলার হাঁসাড়া পর্যন্ত ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে পুলিশের কোন গাড়ি দেখাযায়নি। সড়কের কোথাও পুলিশের কোন অবস্থানও চোখে পড়েনি। এসময় সড়কের চলাচলরত যানবাহনের গতিসীমা কোথাও প্রতি ঘণ্টায় ও ৪০,কোথাও ৬০,কোথাও ৮০ কিলোমিটার লেখা থাকলেও গাড়ির চালকরা তা অমান্য করে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন।
এ সময় এক্সপ্রেসওয়ের আশপাশের কয়েকজন বাসিন্দা সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, সকাল, দুপুর রাত, কুয়াশা, ঝড়-বৃষ্টি সব সময় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায় চালকরা। বিশেষ করে বড় বড় কোম্পানির বাস,ট্রাক ও মোটরসাইকেল গুলোই বেশি এমন করে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিরাতেই এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে কুয়াশা পড়ছে। কুয়াশার কারনে কিছু গাড়ি ধীরে চলে, কিছু গাড়ির গতি সীমার বাইরে ও বেপরোয়াভাবে চালাচ্ছে। এতে করে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা ঘটে প্রাণহানি হচ্ছে। এক্সপ্রেসওয়েতে পুলিশের নজরদারিও তেমন জোরালো না থাকায় ফলে চালকরা কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করছে না। এ সব বিষয়ে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
জানা গেছে, গত রবিবার (২২ ডিসেম্বর) ভোরে এক্সপ্রেসওয়ের মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর থেকে হাসাড়া এলাকা পর্যন্ত কুয়াশার মধ্যে বেপরোয়া গতিতে নিয়ন্ত্রণ হাড়িয়ে ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার জায়গায় ৪টি স্থানে যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, পিকআপ ভ্যান ও কাভার্ডভ্যানসহ ১০টি গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এসব গাড়ি কোথাও সড়ক বিভাজকের সঙ্গে ধাক্কা দেয়। কোথাও একটি গাড়ি আরেকটির পেছনে ধাক্কা দেয়।এ সব দুর্ঘটনায় মো. ফরহাদ হোসেন (৪০) নামে গাড়ির এক চালক মারা যান। এছাড়া ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজায় বাসচাপায় ৬জন নিহত হয়েছেন। গত শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) বেলা ১১টার দিকে এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ অংশের ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন ৫জন।
সড়ক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৈরী আবহাওয়া কিংবা দৃষ্টিসীমা একেবারে কমে গেলে বাংলাদেশে ফেরি ও বিমান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ বা কত গতিতে চলতে দেওয়া উচিত—এ বিষয় দেখভাল করার কোনো ব্যবস্থাই নেই। আধুনিক মহাসড়কগুলোয় ডিজিটাল ব্যবস্থার মাধ্যমে গতি দেখানোর সংকেত বা সাইনবোর্ড থাকে। সেই অনুযায়ী তা মানা হচ্ছে কি না, তা হাইওয়ে পুলিশের দেখার কথা। কিন্তু অবকাঠামো, যানবাহন ও জনবল থাকার পরও হাইওয়ে পুলিশ তা করে না। আর মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েকে বিপুল টাকা খরচ করে আন্তর্জাতিক মানের করা হলেও এর সাইন-সংকেতব্যবস্থা আধুনিক নয়।
সড়ক সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়কটিকে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে বলা হয়। এর নাম ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক’। মহাসড়কটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা বিশ্বে বিরল। ৫৫ কিলোমিটার এই মহাসড়ক নির্মাণে মোট ব্যয় ১১ হাজার কোটি টাকা।
এক্সপ্রেসওয়েতে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, এর পেছনে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে। এ ছাড়া বিপুল খরচের মাধ্যমে নির্মাণ করা এক্সপ্রেসওয়েটি সাইন-সংকেতব্যবস্থাও আধুনিক নয়, গতানুগতিক। এর আগে যমুনা সেতু চালুর পর সেতুটির আগে-পরে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনার ধরন হচ্ছে, ঘন কুয়াশার কারণে একটি যানবাহন দুর্ঘটনায় পড়লে পেছন থেকে একের পর এক যান এসে ধাক্কা দেয়। একে ‘পাইল আপ’ বলে। এ জন্য দৃষ্টিসীমা একেবারে কমে গেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়।
নিহত পান্না বণিকের বোনের মেয়ে তুষি ঘোষ বলেন,প্রায় আধাঘন্টা আমার মাসি ট্রাকের চাকার নিচে পড়েছিল।কেউ উদ্ধার করতে আসেনি।আমাদের অন্য আহতরাও ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। আধাঘন্টা পর পুলিশ আসে।এর পর তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন।পরে মাসিসহ ৬ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান।
তুষি অভিযোগ করে বলেন, শীতের সময় কুয়াশ থাকবে স্বাভাবিক।গাড়ি চালনােও বন্ধ থাকবে না।যদি মহাসড়কে পুলিশের বেশি বেশি নজর দারি থাকতো বেপরোয়াভাবে কেউ গাড়ি চালাতনা। বেপরোয়া গাড়ি না চললে হয়তো প্রাণহানীর মত ঘটনাও ঘটতো না।
হাসাড়া এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন আহমেদ জানান, কুচিয়ামোড়া, ধলেশ্বরী টোলপ্লাজা, হাসাড়া, ষোলঘর, পদ্মা থানা এলাকার কাছাকাছি এক্সপ্রেসওয়েতে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।অথচ পুলিশ এসব এলাকায় নাম মাত্র টহল দেয়। এ টহলে এক্সপ্রেসওয়েতে কোন ভাবে দুর্ঘটনা কমাতে পারবেনা। কুয়াশাসহ বিভিন্ন দুর্যোগে পুলিশসহ সড়কের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের জোড়ালো আইন প্রয়োগ করা দরকার। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশের নিরাপত্তা চকি বসানো দরকার।সড়ক আইন মানেনা এমন চালকদের ও পরিবহন মালিকদের বিচারের আওতায় আনা দরকার তাহলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।
শ্রীনগর ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা দেওয়ান আজাদ হোসেন বলেন, এসব দুর্ঘটনা ঘন কুয়াশায় ফগ লাইট না জ্বালানোর কারণে, ট্রাফিক আইন না মেনে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, চালকদের গাফলতি, ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি চালানো, আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা, যত্রতত্র গাড়ি থামানো, ত্রুটিযুক্ত গাড়ি রাস্তায় বের করার কারনে ঘটেছে। এসব ঘটনা রাতের আধারে, ঘন কুয়াশা এবং বৃষ্টির মধ্যে বেশি হয়েছে। ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালানো, চালকদের বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষিত করা ও যাত্রীরা সচেতন হলেই এই দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।
পুলিশের টহলদারি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাসাড়া হাইয়ে থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী জানান, প্রতিদিন রাতে দুটি গাড়ি দিয়ে ধলেশ্বরীর টোলপ্লাজা থেকে শুরু করে মাওয়া এলাকার প্রায় ২৯.২ কিলোমিটার এলাকায় টহল দিচ্ছেন তারা। সে সময় চালকদের বারবার ট্রাফিক আইন মেনে এবং কম গতিতে গাড়ি চালাতে বলা হচ্ছে। পুলিশের সামনে কম গতিতে গাড়ি চালালেও পুলিশ দুরে চলে গেলে আবার ব্যাপোরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন চালকরা। এর ফলে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তিনি।
হাসাড়া হাইওয়ে থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী বারবার সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে আরো বলেন, যে দুটি রবিবার ও সোমবার যে দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে দুটোই ভোর বেলা ঘটেছে।আর এ সময় অতিরিক্ত কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে এক্সপ্রেসওয়ে।দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে অতিরিক্ত ঘন কুয়াশা ও চালকদের বেপরোয়া গতির কারণে। সড়ক আইন মেনে যদি চালকরা গাড়িচালাতেন তাহলে হয়তো এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না।
বেপরোয়া চালক ও পরিবহনের বিরুদ্ধে প্রতিদিন আইনি কার্যক্রম চলছে বলে দাবি মুন্সীগঞ্জ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকারের। তিনি বলেন, দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে চালকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। অন্যদিকে কিভাবে দুর্ঘটনা রোধে প্রতিনিয়ত আইনের মাধ্যমে জরিমানাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এইচএ