রাজধানীর মিরপুরে ডিএমপির শাহ আলী থানা এলাকায় প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ মরণনেশা মাদকদ্রব্যের রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে আসছে একাধিক সংঘবদ্ধ চিহ্নিত মাদক কারবারিরা। এমনকি পোশাক পরিহিত ডিউটিরত পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতেই মাছের বাজারের মত পথচারীদেরকে ডেকে ডেকে বিক্রি হচ্ছে গাঁজা, ইয়াবাসহ বিভিন্ন প্রকার নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য। তবুও যেন দেখার কেউ নেই।
প্রকাশ্য দিবালোকে নিষিদ্ধ মাদক দ্রব্যের এমন রমরমা বাণিজ্য প্রশ্নবিদ্ধ করেছে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
মাদকের সর্গরাজ্য হিসেবে শাহ আলী থানাধীন গুদারাঘাট, বিশিল, শাহ আলী মাজারের আশপাশ, মিরপুর-আশুলিয়া বেড়িবাঁধ এলাকার কুখ্যাতি আজকের নয়; বরং বহু পুরনো।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে কিছুদিন মাদক বিক্রির পরিধি কমেছিল। গত ৫ ই আগস্ট সরকারের পতনে পর পরিস্থিতি বুঝে নিজেদের ভোল পাল্টে ফের রমরমা মাদক বাণিজ্যে সক্রিয় হয়েছে তারা।
স্থানীয় স্বার্থান্বেশী, নামধারী ও কথিত পাতি নেতা পরিচয়ধারীদের সহযোগীতায় একাধিক বিএনপি নেতাদের নাম ভাঙিয়ে নিয়ে সুকৌশলে যার যার নিজ এলাকায় ফের অপরাধের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলতে উঠে পড়ে লেগেছে সঙ্ঘবদ্ধ ও সূচতুর এসকল চিহ্নিত মাদক কারবারীরা।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কেউ কেউ পুরো পরিবার নিয়ে নবোদ্যমে গুদারাঘাট এলাকায় নতুন করে গড়ে তুলেছেন সুবিশাল মাদক সিন্ডিকেট। মাদক মামলায় সাজা ভোগ করে সম্প্রতি আদালতের মাধ্যমে মুক্ত হয়ে বের হয়ে আসা মনির ওরফে পিচ্চি মনির, তার শ্যালক আজগর আলী, সালিকা তানিয়া আক্তার ও তার ছেলে আকাশ নিয়ন্ত্রণ করছে গুদারাঘটের এইচ ব্লকের ৪ ও ৫ নম্বর নম্বর রোডের বিশাল মাদকসম্রাজ্য। তাদের গডফাদার হিসেবে নেপথ্যে কাজ করছে মোকসেদ আলী ওরফে মুখ্যা। বেড়িবাঁধ এলাকা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করছে বাবু ও হনফা।
রয়েল সিটি বেড়িবাঁধ এলাকায় মনির, গুদারাঘাট এইচ ব্লক ১৫ নম্বর রোডে কাকড়া জাকির দম্পতি, এইচ ব্লকের ৬ নম্বর রোডে গাঁজা ও ইয়াবা বিক্রি করে আসছে আশিক, দাদন, আলম, মনু ওরফে বাবুর্চি মনির। কাজীফুরী প্রাইমারি স্কুলের সামনে গাঁজার স্পট চালাচ্ছেন রিপন। উত্তর বিশিলে হিরোইন বিক্রি করে আসছে কাজী মনির ও সোর্স জসিম। একই সড়কে পুলিশের কথিত সোর্স পরিচয় দাপটের সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে আসছে মন্টু।
এলাকাবাসীর আরো দাবি করেন, পুরো মিরপুরে পাইকারি ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি ও কুখ্যাতি রয়েছে নিউ সি ব্লকের মাদকসম্রাট রাসেল ওরফে কাউন্টার রাসেলের। শাহ আলী থানাধীন নিউ সি ব্লকের স্বঘোষিত মাদক সম্রাট কাউন্টার রাসেলের এই বিশাল মাদকসম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে নিজের ভাই রাজীবসহ সঙ্ঘবদ্ধ ২০-২৫ জনের একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। তাদের মধ্যে শাহআলী মনির ওরফে ভেজাল মনির, হাতি বাবু, রাসেলের ডান হাত খ্যাত সবুজ ওরফে ফর্মা সবুজ, বিপ্লব পিচ্চি সুমন, মাহি, পাকনালীটন ও ভাগিনা সুজন।
অপরদিকে ডি ব্লকের বিশাল এলাকাজুড়ে ইয়াবা সম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন বাবু, রবিন ও প্রিন্স। আর চিড়িয়াখানা রোডের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও আশপাশের এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে ফারুক, রাসেল, বাবু ও মানিক কসাই। পার্শ্ববর্তী বক্সনগরে আমুদ আলী ওরফে বাঘা গাঁজা ও ইয়াবা বিক্রি করে আসছে।
সবচেয়ে ভয়ানক অবস্থা দেখা গিয়েছে হযরত শাহ আলী মাজারকেন্দ্রিক এলাকায়। যেখানে বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্যের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন একটি সংঘবদ্ধ প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। কয়েক ঝাক ভাসমান মাদক ব্যবসায়ী প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের সামনেই জনসম্মুখে ডেকে ডেকে বিক্রি করছেন নানা রকম মাদকদ্রব্য। মধ্যবয়সী নারী শিশু কিশোর কিশোরীদেরকে ব্যবহার করে এই অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার মাদকের অবাধ কারবার চালিয়ে আসছে হোসেন-ইতি দম্পতি। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদেরকে শারিরীক নির্যাতনসহ নানা হয়রানীর শিকার হতে হয়।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আরও গভীর চাঞ্চল্যকর রোমহর্ষক তথ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকাবাসী জানিয়েছেন, বৃহত্তর মিরপুর এলাকায় প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি কথিত মাদকদ্রব্য নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। তবে সেখানে চিকিৎসা নয় বরং চিকিৎসার অন্তরালে চালানো হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্যের রমরমা বাণিজ্য। এমনকি এই মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলো প্রতিষ্ঠা পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ ব্যাক্তিবর্গই মাদকাসক্ত এবং ব্যবসায়ী।
অপরদিকে মিরপুর মডেল থানা এলাকার এ ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ভেজাল মনিরের সহায়তায় দেদারসে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছে এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী পাখি ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী আজমেরি দম্পতি। ভেজাল মনিরের নেতৃত্বে কথিত ড্যান্সার এই আজমেরীর ভাই সাইফুল, পিঙ্কি ওরফে বৃষ্টি, পাখির ভাই বাদলের স্ত্রী মুক্তা ও তাদের দেবর গালিব বর্তমানে এলাকায় ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকের রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে আসছে।
থানা পুলিশ ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্থানীয়রা আরো দাবি করেন, এই চিহ্নিত অপ্রতিরোধ্য কিশোর গ্যাং ও মাদক ব্যবসায়ীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতায় স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ঝুঁকে পড়ছে মাদকের দিকে। দিন দিন এ অঞ্চলে চুরি ছিনতাই, হানাহানির পরিমাণ বৃদ্ধিসহ ইভটিজিং নারী হয়রানি বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। স্থানীয় প্রশাসন তাদের দায়িত্ব পালনেও অবহেলা করছেন। প্রশাসনের বলিষ্ঠ ভূমিকাই এসকল অপরাধ নির্মূলসহ অপরাধীদেরকে আইনের আওতায় আনতে পারে।
এ বিষয়ে শাহ্ আলী থানার নবাগত অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শফিকুল ইসলাম সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, আমি গত ১৯ ডিসেম্বর শাহ আলী থানাতে যোগদান করেছি। থানা এলাকা সম্পর্কে ধীরে ধীরে অবগত হচ্ছি। মাদক ব্যবসায় আমাদের সমাজে একটি ঘৃণিত অপরাধ। আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত শাহ আলী থানা এলাকায় মাদক ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেলে অপরাধী যেই হোক; যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।