বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মিছিল থেকে ধরে নিয়ে রাজমিস্ত্রি তোফাজ্জলকে (২৪) পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় ময়মনসিংহের ভালুকার মাস্টারবাড়ি এলাকায় ওই ঘটনাটি ঘটে। শহিদ তোফাজ্জল হোসেন নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার পিজাহাতি গ্রামের মৃত আব্দুর রশিদের ছেলে। ৩ মাস পার হয়ে গেলেও এ হত্যাকাণ্ডের কোনো মামলা হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী নিহত তোফাজ্জলের বন্ধু মামুন ও স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের অংশ হিসাবে গাজীপুরের শ্রীপুরের সীমান্তবর্তী জৈনা বাজার থেকে একটি মিছিল ভালুকা উপজেলার মাস্টারবাড়ি এলাকায় আসে।
এ সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লোকজন মিছিলটি প্রতিহতের লক্ষ্যে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। এতে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তখন তোফাজ্জল হোসেনকে মিছিল থেকে ধরে নিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করা হয়। পরে স্থানীয়রা তোফাজ্জলকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে মাস্টারবাড়ি এলাকার একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে ডাক্তার চিকিৎসা না দিলে তাকে গাজীপুরের শ্রীপুর সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তোফাজ্জলকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাশটি শ্রীপুর থানার এসআই ওয়াহিদুজ্জামানের কাছে হস্তান্তর করেন। ৫ আগস্ট পুলিশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। ৬ আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টায় তোফাজ্জলের গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।
বাবা হারা তোফাজ্জল মা ও ছোট ভাই মোফাজ্জলকে (২১) নিয়ে শ্রীপুরের নগর হাওলা এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে থেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাতেন। হত্যাকাণ্ডের তিন মাস পার হলেও হতদরিদ্র পরিবার পক্ষ থেকে কোনো মামলা করতে পারেননি। এদিকে একটি প্রভাবশালী মহল হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে এমনকি আইনি সহায়তা না দিতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় আদালতে একাধিক অভিযোগ দায়ের করা হলেও রহস্যজনক কারণে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
তবে সন্তান হত্যার বিচার চেয়েছেন মা হাজেরা খাতুন। তিনি বলেছেন, দুই ছেলে ও তিন মেয়েকে ছোট রেখেই ২০০৪ সালে তার স্বামী মারা যান। এরপর থেকেই জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে সন্তানদের তিনি বড় করেন এবং তিন মেয়েকে বিয়ে দেন। চার বছর আগে দুই ছেলে তোফাজ্জল ও মোফাজ্জল হোসেনকে নিয়ে শ্রীপুরে থাকতে শুরু করেন। ভাড়া বাড়িতে থেকে তোফাজ্জল রাজমিস্ত্রি ও মোফাজ্জল পোশাক কারখানায় এবং তিনি নিজে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে জীবন চালাতেন। ৪ আগস্ট তোফাজ্জল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মিছিলে গিয়ে নিহত হয়। ৬ আগস্ট গাজীপুর শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ছোট ভাই মোফাজ্জল হোসেন জানান, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মিছিলের সঙ্গে ভালুকার মাস্টারবাড়িতে গেলে তাকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হতদরিদ্র হওয়ায় তিন মাস পার হলেও তারা মামলা করতে পারছেন না। ভাইকে হারানোর পর তার মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তাছাড়া বাসা ভাড়া পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাই নিরুপায় হয়ে তিনি মাকে নিয়ে গ্রামে চলে যান। এখন তিনি মানুষের খেতেখামারে শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। ভাইকে হারানোর বিনিময়ে দ্বিতীয়বার দেশ স্বাধীন হলেও কর্মসংস্থানের অভাবে তিনি মাকে নিয়ে চরম দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি তার ভাই হত্যার বিচার দাবি করেন।
এদিকে হত্যা ঘটনায় তোফাজ্জলের পরিবার আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে না পারায় ভালুকা মডেল থানায় রকিবুল হাসান নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়ে ১৩৫ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত আরও ২০০ জনের নামে একটি মামলা করেন। এ ছাড়া হৃদয় মাহমুদ জান্নাতও আরেকটি মামলা করেছেন। পরবর্তীতে রহস্যজনক কারণে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
ভালুকা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সামছুল হুদা খান জানান, অভিযোগ দেওয়ার বিষয়টি তিনি শুনেছেন। তবে তার যোগদানের আগে দেওয়া হয়েছিল। তবে অভিযোগটি বের করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এসএফ