‘আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিমুদ্দীর ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। বাড়ি তো নয় পাখির বাসা-ভেন্না পাতার ছানি, একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।’ পল্লী কবি জসীম উদদীনের সেই বিখ্যাত আসমানী কবিতার সাদৃশ্য যেন অভিরাম দাসের নিবাস।
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার ৫নং অলোয়া ইউনিয়নের চরনিকলা গ্রামের বাসিন্দা অভিরাম দাস (৬২)। যিনি বংশী নামেই পরিচিত এলাকায়। সহায়-সম্বল না থাকায় অসুস্থ স্ত্রী শ্যামলীকে নিয়ে পলিথিনে মোড়ানো একটি জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করছেন তিনি। দুইবছর ধরে মানবেতর জীবনযাপন করলেও স্ত্রীর নামে একটি প্রতিবন্ধি ভাতার কার্ড ছাড়া সরকারি কোনো সাহায্য সহায়তা ভাগ্যে জুটেনি ভূমিহীন অসহায় এই দম্পত্তির।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বৃদ্ধ বয়সে নিজের বলতে কিছুই নেই অভিরাম দাসের। অসুস্থ স্ত্রী শ্যামলী দাসকে নিয়ে কোনো রকম দিনপার করছেন। নিজের কোন জায়গা না থাকায় কয়েক বছর আগে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় অন্যের একটি বাঁশঝাড়ে ৬টি টিনের চালার নিচে বসবাস শুরু করেন তারা। সেই টিনের চালার ফুটো দিয়ে পানি পড়ায় পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তবুও অধিক বৃষ্টি হলে রক্ষা মেলে না তাদের, পানিতে টইটম্বুরও হয়ে যায় ঘর। জোড়াতালি এ ভাঙা ঘরেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে চলছেন অভিরাম-শ্যামলী দম্পতি।
জানা গেছে, একছেলে চৈতন্য দাস ও এক মেয়ে গৌড়ি দাস এবং স্ত্রী শ্যামলী দাসকে নিয়ে এক যুগ আগে বাড়ির জায়গা-জমি বিক্রি করে পাড়ি জমিয়েছিলেন প্রতিবেশি দেশ ভারতের কৃষ্ণনগরে। সেখানে ভাইয়ের বাড়ির কাছে জায়গা কিনে কাজ করে ছেলে-মেয়েকে বড় করে তুলেন। দুই সন্তানকে বিয়ে দেন সেখানেই। একদিন হঠাৎ বিদ্যুৎতায়িত হয়ে স্ত্রী শ্যামলীদাস গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সঠিক চিকিৎসার অভাবে ধীরে ধীরে সে হাটা চলার সামর্থ্য হারিয়ে শারীরিকভাবে পুরোপুরি অক্ষম হয়ে যায়। মায়ের এমন পরিস্থিতিতে একমাত্র ছেলে চিকিৎসা করানো তো দূরে থাক, বাবা-মাকে আর ভাতও দিতে চায় না। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে একপর্যায়ে স্ত্রীকে নিয়ে খালি হাতে নিজ দেশে ফিরে আসেন অভিরাম।
জানতে চাইলে চোখ মুছতে মুছতেই অভিরাম সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, শেষ বয়সে সন্তানেরা বাবা-মায়ের যত্ন নেবে এটাই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু আমরা আমাদের সন্তানের কাছে বোঝা হয়ে গেলাম। তারা আমাদের দ্বায়িত্ব নেবে না বলে জানিয়ে দিল। মনের দুঃখে দু'বছর আগে নিজের কিছু নেই জেনেও স্ত্রীকে নিয়ে দেশেই চলে আসি। এখানে আসার পর এবাড়ি-ওবাড়ি থাকি। আমার এক আত্নীয়ের কাছে বলার পর তার এই বাঁশ ঝাড়ে কোন রকম থাকার জায়গা দেয়। বাকিটা গ্রামের ছেলেরা চাঁদা তুলে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, বৃষ্টি হলে পাশের পচা পুকুরের জল ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। বর্ষাকালে এমনিতেই এখানে পানি থাকে। আমি নিরুপায়, কিছু করার নেই। প্রতিদিন সকালে বাজারে কিছু মাছ বিক্রি করি, কোনদিন ২০০ টাকা কখনো ৩০০ টাকা রোজগার হয়। তা দিয়েই কোনোমতে সংসার চালাই। এই অসুস্থ মানুষটারে রেখে কোথাও যেতে পারি না। তার সমস্ত কাজ, রান্না থেকে শুরু করে গোসল করানো, খাওয়ানো এবং নোংরা কাজগুলোও আমার করতে হয়। আমি না থাকলেই কান্নাকাটি করে। তারে তো দেখার কেউ নেই।
আক্ষেপ করে অভিরাম দাস বলেন, সরকারি সহযোগিতা বলতে কেবল স্ত্রীর নামে একটা প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড পেয়েছি। সরকার যদি আমাকে সহযোগিতা করে তাহলে বুড়ো বয়সে স্ত্রীকে নিয়ে একটু দুবেলা দুমুঠো খেতে পারতাম।
একই এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য মোখলেছুর রহমান বলেন, অভিরাম আমার বাড়ির পাশেই একটি বাঁশঝাড়ে জরাজীর্ণ একটি ছাপড়ার নিচে থাকেন। তিনি দরিদ্র থাকলেও কখনো কারো কাছে হাত পাতেন না। তিনি বাজারে মাছ বিক্রি করে তার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিনপার করেন। আমি যতদিন জনপ্রতিনিধির দ্বায়িত্ব পালন করেছি তাকে সহযোগিতা করেছি। সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানদের অসহায় এই দম্পতির পাশে দাঁড়ানো উচিৎ।
অলোয়া ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম হাসান সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, অভিরাম দাস আমার ইউনিয়নের ভেতরে এত নিঃস্ব আমি জানতাম না। তার বাড়িতে গিয়ে খবর নিয়ে দেখলাম, সে সত্যিই খুব অসহায়। তার জন্য যতটুকু সম্ভব সুযোগ-সুবিধা, বিশেষ করে তার ঘর এবং খাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দেবো ইনশাআল্লাহ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. পপি খাতুন সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, অভিরামের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমি ইতিমধ্যে অবগত হয়েছি। যদিও তার সঙ্গে এখনও আমার দেখা হয়নি। তাকে আসতে বলেছি, পিআইও ও সমাজসেবা অফিস থেকে যতটুকু আর্থিক সহায়তা প্রদান করা সম্ভব, আমরা সেটি করব। পরবর্তীতে আমাদের যদি আরও কোনো করণীয় থাকে, সেটি দিয়েও তাকে সাহায্য করব।