দুপুর গড়াতেই ‘সাদা অ্যাপ্রোন’ পরা কয়েকজন নারী দলবদ্ধভাবে প্রবেশ করেন যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের পুরুষ ও মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে। তাদের চিকিৎসক ভেবে রোগীর স্বজনরা নড়েচড়ে বসেন। চিকিৎসক বেশে তারা সিভিডিতে (ব্রেইন স্ট্রোক) আক্রান্ত রোগীদের কাছে যান। এরপর নতুন ভর্তি হওয়া প্রতি রোগীকে ৩শ’ টাকার বিনিময়ে ফিজিওথেরাপি (শারীরিক চিকিৎসা) দেয়া শুরু করেন।
এর আগে চক্রের সদস্যরা চিকিৎসাধীন রোগীদের মাথার কাছে ফিজিওথেরাপি সেন্টারের পরিচিতি কার্ড রেখে আসেন। এভাবে তারা সরকারি হাসপাতালকে পুঁজি করে রীতিমত ব্যবসার ফাঁদ পেতেছিল। এককভাবে বাণিজ্য করতে একাধিক ফিজিওথেরাপি সেন্টারের কর্মীরা পেশীশক্তি প্রয়োগও করছিলেন। লাগাম টানতে তাদের সরকারি হাসপাতালে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। শনিবার রাতে এ তথ্য নিশ্চিত করে হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক ডা. হুসাইন শাফায়াত জানান, নির্দেশ অমান্য করে ফিজিওথেরাপি কর্মীরা ওয়ার্ডে গেলেই পুলিশকে গ্রেফতার করতে বলা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেনারেল হাসপাতালকে ঘিরে ১৩টি অবৈধ ফিজিওথেরাপি সেন্টার গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে সেবা ফিজিওথেরাপি সেন্টার, শাহজালাল ফিজিওথেরাপি সেন্টার, সোনালী ফিজিওথেরাপি সেন্টার, নাজনীন ফিজিওথেরাপি সেন্টার, মেঘনা ফিজিওথেরাপি সেন্টার উল্লেখযোগ্য। এসব প্রতিষ্ঠানের অযোগ্য কর্মীরা ডাক্তারের পোশাক পরে রীতিমত ব্যবসার ফাঁদ পেতেছে। ফিজিওথেরাপিস্ট ছাড়াই একটি চক্র নামমাত্র ফিজিওথেরাপি সেন্টার খুলে ধান্দাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন। চক্রের প্রায় সব সদস্য নারী। অভিযোগ উঠেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা না মেনে একাধিক সেন্টারের সদস্যরা গায়ে অ্যাপ্রন পরে চিকিৎসকের বেশে ওয়ার্ডে অবাধে প্রবেশ করছেন। প্রথম দেখাতে তাদেরকে যে কোন রোগীর স্বজন চিকিৎসক ভেবে নেন। রোগীর ফিজিওথেরাপির নামে তারা স্বজনদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা লুফে নিচ্ছেন। তাদের কর্মকাণ্ডে রোগীরা উপকারের পরিবর্তে ক্ষতির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা এদের ফিজিওথেরাপিতে কোন ডিগ্রি নেই। অথচ তারা বাণিজ্য বাড়াতে হাসপাতালের ওয়ার্ড দখলের জন্য রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এরই জের ধরে গত বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে শাহজালাল ফিজিওথেরাপি ও মেঘনা ফিজিওথেরাপি সেন্টারের কর্মীরা মারামারিতে লিপ্ত হন। এই ঘটনায় শাহজালাল ফিজিওথেরাপি সেন্টারের মালিক দিলারা পারভীন ও মেঘনা ফিজিওথেরাপি সেন্টারের মালিক গোলাম রসুল কোতোয়ালি মডেল থানায় পাল্টাপাল্টি লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগ দুটি পুলিশ তদন্ত করছেন।
পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন একাধিক রোগীর স্বজন জানান, গায়ে চিকিৎসকের সাদা অ্যাপ্রোন পরা ও গলায় কার্ড ঝুলানো মহিলারা ওয়ার্ডে আসে। রোগী নতুন ভর্তি হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করেন। এরপর ৩শ’ টাকা নিয়ে ফিজিওথেরাপি দেন। তারা আরও জানান, অনেকেই তাদেরকে চিকিৎসক ভেবে নেন। পরে বুঝতে পারেন ফিজিওথেরাপি সেন্টারের লোক।
বিগত দিনে হাসপাতালের পুরুষ- মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ড ও পুরুষ-মহিলা পেইং ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় রোগীর মাথার কাছে বিভিন্ন ফিজিওথেরাপি সেন্টারের ভিজিটিং কার্ড রয়েছে। জানতে চাইলে পুরুষ পেইং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন জানান, সাদা অ্যাপ্রন পড়া এক নারী কার্ড রেখে গেছেন। দুপুর দুইটার পর রোগীর কোন সমস্যা হলে কার্ডের নম্বরে কল করতে বলেছেন।
অভিযোগ উঠেছে, ব্যবসার স্বার্থে ফিজিওথেরাপি সেন্টারের নারীরা চিকিৎসকের মতো সাদা অ্যাপ্রোন পরে রোগীর কাছে যান। তারা কেউ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফিজিওথেরাপিস্ট নন। অথচ তারা ফিজিওথেরাপিস্ট সেজে রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। অথচ ফিজিওথেরাপি মানে কি সেটাই জানেন না অ্যাপ্রন পরা চক্রের অনেক সদস্য। সূত্র আরও জানায়, তাদের ব্যবসা বাড়াতে হাসপাতালের ওয়ার্ডে দায়িত্বরত কর্মচারীদের (ওয়ার্ডবয়/আয়া) সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ রক্ষা করেন। সিভিডি রোগী ভর্তি হলে তাদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়া হয়। বিনিময়ে কর্মচারীরা তাদের কাছ থেকে কমিশন পেয়ে থাকেন।
বিগত দিনে যশোরের সাবেক সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন অভিযান চালিয়ে নানা অনিয়মের সত্যতা পেয়ে তিনটি ফিজিওথেরাপি সেন্টার বন্ধ ঘোষণা করেছিলেন। পরে তিনি অন্যত্র বদলী হয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো ফের চালু করা হয়। সেই থেকে অবৈধভাবে চলে আসলেও স্বাস্থ্য বিভাগের বর্তমান কর্মকর্তারা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেনারেল হাসপাতালের একজন সিনিয়র সেবিকা জানান, ফিজিওথেরাপি সেন্টারের ‘ওরা’ যখন গায়ে অ্যাপ্রন পরে দলবেধে ওয়ার্ডে প্রবেশ করেন তখন নিজেদের খুব অসহায় মনে হয়। সহজ সরল মানুষ তাদেরকে চিকিৎসক ভেবে রোগের বর্ণনা করেন। ফিজিওথেরাপির নামে প্রতি রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ৩শ’ টাকা আদায় করা হয়।
মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসক জানান, ফিজিও (শারীরিক) এবং থেরাপি (চিকিৎসা) শব্দ দুটি মিলে হয় ফিজিওথেরাপি বা শারীরিক চিকিৎসা। ফিজিওথেরাপি আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অন্যতম এবং একটি অপরিহার্য শাখা। শুধু ওষুধ সব রোগের পরিপূর্ণ সুস্থতা দিতে পারে না। বিশেষ করে বিভিন্ন মেকানিক্যাল সমস্যা থেকে যেসব রোগের সৃষ্টি হয়, তার পরিপূর্ণ সুস্থতা লাভের উপায় ফিজিওথেরাপি। একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি হলো ফিজিওথেরাপি, যেখানে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর সব কথা শুনে-বুঝে, রোগীকে ভালোভাবে দেখে এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর সঠিক রোগ, আঘাত বা অঙ্গ বিকৃতির ধরন নির্ণয় করে রোগীকে বিভিন্ন ধরনের ফিজিক্যাল মেথড যেমন-ম্যানুয়াল টেকনিক, তাপ ও ব্যায়ামের মাধ্যমে চিকিৎসা করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফিজিওথেরাপিস্ট প্রয়োজন। অন্যথায় রোগীর আরও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তিনি আরও জানান, সরকারি হাসপাতালে ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়োগ দেয়া হলে রোগীদের অনেক সুবিধা হতো।
জেনারেল হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্র জানিয়েছে, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ফিজিওথেরাপি সেন্টারের কর্মীদের হাসপাতালে রাজত্ব চলছে। তারা হাসপাতালের পুরুষ ও মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ড এবং পেইং ওয়ার্ড দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সেখানে এককভাবে বাণিজ্য করতে একাধিক ফিজিওথেরাপি সেন্টারের কর্মীরা পেশীশক্তি প্রয়োগ করছেন। রোগীদের থেরাপি দেওয়ার জন্য ওয়ার্ড ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ফিজিওথেরাপি সেন্টারের কর্মীরা হাসপাতালের মধ্যে মারামারি করছেন। এতে সরকারি হাসপাতালের বদনাম হচ্ছে। বিগত দিনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফিজিওথেরাপি কর্মীদের প্রবেশ করতে মৌখিকভাবে নিষেধ করলেও তারা কর্ণপাত করেননি। তারা ইচ্ছামত হাসপাতালে ঢুকে থেরাপি বাণিজ্য করে আসছেন। তাদের বিরুদ্ধে নতুন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
এই বিষয়ে হাসপাতালের সদ্য যোগদানকৃত তত্ত্বাবধায়ক ডা. হুসাইন শাফায়াত জানান, ফিজিওথেরাপি সেন্টারের কর্মীরা গায়ে হাসপাতালে আসার কোন নিয়ম নেই। তারা অবৈধভাবে হাসপাতালে প্রবেশ করেন। হাসপাতালকে ঘিরে তাদের ফিজিওথেরাপি বাণিজ্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়াও ইচ্ছামতো রোগীদের থেরাপি দিচ্ছেন বলে শুনেছেন। বিগত দিনে তাদের হাসপাতালে প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও তারা মানেননি। গত ২৪ জুলাই ফিজিওথেরাপি কর্মীরা হাসপাতালের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত হন। যা কোনভাবে কাম্য নয়। ফিজিওথেরাপি সেন্টারের কর্মীদের হাসপাতালে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কোন ওয়ার্ডে তাদের দেখলেই গ্রেফতার করার জন্য হাসপাতালে দায়িত্বরত পুলিশকে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ২৫ জুলাই শুক্রবার সময়ের কন্ঠস্বর নিউজ পোর্টালে ‘যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের ওয়ার্ড দখলে মরিয়া ফিজিওথেরাপি কর্মীরা!’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এনআই