ময়মনসিংহ রেলপথে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মৃত্যুর পরও রেললাইনগুলো ব্যবহার হচ্ছে হাঁটার পথ হিসেবে, অথচ এটি যে আইনত: নিষিদ্ধ সেই খবরও অনেকেই রাখেন না।
অনেকে রেললাইন ধরে হাটা নিরাপদ মনে করেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যখন দুই দিক থেকেই ট্রেন আসে তখন তারা বুঝতে না পেরে একদিকে সরে দাঁড়ান এবং ট্রেনের নীচে পড়েন। এছাড়া অনেকেই রেললাইনে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলেন বা হেডফোন লাগিয়ে রাখেন কানে।
গেল ২০২৪ সালের ২৩ এপ্রিল ময়মনসিংহ নগরীর পঁচাপুকুরপাড় এলাকার রেলক্রসিংয়ে বিয়ের বাজার করে অটোরিকশায় চড়ে বাড়ি ফিরছিলেন একই পরিবারের নারীসহ দুইজন যাত্রী, কিন্তু রেলক্রসিংয়ের একটি বেড়িয়ার নষ্ট থাকায় অটোরিকশাটি রেললাইনে ওঠে পড়ে ঠিক সেসময় জামালপুরগামী ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেনের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, এতে অটোরিকশার দুই যাত্রী ট্রেনের চাকায় কাটা পড়ে নিহত হন।
নগরীর পঁচা পুকুরপাড় এলাকার একাধিক বাসিন্দা নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এখানে একটি ছোট্ট রেলক্রসিং আছে, ট্রেন আসলে একপাশ থেকে দেখা যায় না, আবার যেপাশ থেকে দেখা যায় না, সেখানকার বেড়িয়ারটা ১ বছর যাবত নষ্ট হয়ে পড়ে আছে, যার কারণে প্রায়ই রেললাইনে যানবাহন ওঠে পড়ছে, ঘটছে ছোটখাটো দূর্ঘটনা।
আরেক বাসিন্দা বলেন, দিনে যে কয়বার ট্রেন আসে, গেইটম্যান বেড়িয়ার নামালেও অনেক যানবাহনের চালক জোর করে পার হতে চায়, বাধা দিলে গেইটম্যানকে গালাগালি করে, বিভিন্ন সময় গায়ে হাত তুলে। মানুষ নিজ থেকে সচেতন না হলে কিচ্ছু করার নেই।
রেললাইনে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করে ময়মনসিংহ রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আকতার হোসেন বলেন, রেললাইন বসে থাকা, মোবাইল গেমিং করা, সখেরবশে সেলফি তুলতে আসা এসব বন্ধ করতে হবে। আমরা বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে থাকি, প্রতিমাসে ওপেন হাউজডের মাধ্যমে সভা করি।
১৮৯০ সালের রেল আইনে রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফুটের মধ্য দিয়ে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ। এমনকি এর মধ্যে গরু-ছাগল ঢুকে পড়লে সেটিকেও নিলামে বিক্রি করে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষের। রেলে কাটা পড়ে কেউ আহত হলে উল্টো ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধেই মামলা করতে পারে রেলওয়ে। এতসব কঠোর নিয়ম থাকার পরও প্রতিবছর প্রায় একশোর মতো মানুষের এভাবে মৃত্যু হচ্ছে।
"রেললাইনে প্রতিবছর এত মৃত্যুর দায় রেল কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এড়াতে পারে না বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। রেল পুলিশের হিসেবে ২০২৪ ও ২৫ এর শুরুতে রেললাইনে কাটা পড়ে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে প্রায় একশজন মানুষের।
দুর্ঘটনা এড়াতে রেললাইনকে সুরক্ষিত করার কথা বলছেন আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ফারজানা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, রেলের আইন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে, পাশাপাশি আইনের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। রেলপথকে সুপরিকল্পিতভাবে সুরক্ষিত করতে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি রেলে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা না করে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড কিনা সেটা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে বের করার পরামর্শও দেন তিনি।
কিন্তু যে রেললাইন দিয়ে চলাফেরা করা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা থেকে মানুষকে বিরত রাখা যে খুব সহজ নয় জানালেন ময়মনসিংহ রেলওয়ে সুপারিন্টেন্ডেন্ট নাজমুল হক খান।
তিনি বলেন, রেললাইনের দু'পাশের ১০ ফিট জায়গাজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা থাকে, এখানে সম্পূর্ণ চলাচল নিষেধ। কিন্তু তারপরও মানুষ অসচেতনতাবশত, খেয়ালখুশিমতো অথবা আত্মহত্যা জনিত কারণে রেললাইনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
এমআর