চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যতম বন্দরনগরী, যেখানে যানজট ও অবৈধ যানবাহন এখন প্রধান নাগরিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত রিকশার বেপরোয়া চলাচল নগরীর সড়ক ব্যবস্থাকে কার্যত অকার্যকর করে তুলেছে। সন্ধ্যার পর থেকে এই যানগুলো রাস্তায় নামার পর যেন পুরো নগরীর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় এক শ্রেণির অদক্ষ, অপরিণামদর্শী চালকদের হাতে। ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা, বাড়ছে জনদুর্ভোগ।
চট্টগ্রামের অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান সড়কে প্রতিদিনই ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য লক্ষ্য করা যায়। দিনের বেলায় কিছুটা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে এই যানগুলোর দাপট বেড়ে যায় বহুগুণ। রাত যত গভীর হয়, ততই এদের গতি বেড়ে যায় বিদ্যুৎগতিতে। ফলে প্রতিনিয়ত ছোট-বড় দুর্ঘটনা লেগেই আছে। পথচারী, সাধারণ যাত্রী, এমনকি অন্যান্য যানবাহনের চালকরাও পড়ছেন বিপাকে।
শুধু দুর্ঘটনাই নয়, এদের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে অসহনীয় যানজটও। ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর নিয়ন্ত্রণহীন ও বিশৃঙ্খল চলাচলের ফলে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যানজট নিত্যদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে কর্মজীবী মানুষ প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থেকে মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন।
ব্যাটারিচালিত রিকশার ভয়াবহতা সম্পর্কে নাগরিক সমাজ, বিশেষজ্ঞ মহল ও বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছে। বিভিন্ন সময় এই যান বন্ধের দাবি উঠলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে ট্রাফিক পুলিশ অভিযানে নামলেও কোনো অদৃশ্য কারণে সেই অভিযান বন্ধ হয়ে যায়।
আইনের দৃষ্টিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ হলেও নগরীর অলিগলি থেকে শুরু করে এশিয়ান হাইওয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সড়কেও এদের অবাধ বিচরণ রয়েছে। চট্টগ্রামের চকবাজার, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, কাজীর দেউড়ি, নতুন ব্রিজ, টাইগারপাস, অক্সিজেন মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় এদের আধিপত্য সুস্পষ্ট। মূলত অবৈধভাবে পরিচালিত গ্যারেজ থেকে এসব যান রাস্তায় নামানো হচ্ছে, যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগও নেওয়া হচ্ছে অবৈধভাবে।
এই ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো চার্জ দেওয়ার জন্য যে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়, তার বেশিরভাগই অবৈধ সংযোগ থেকে নেওয়া। ফলে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। লোডশেডিংয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা এই বিদ্যুৎ চুরিকেও দায়ী করছেন।
ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকদের বেশিরভাগই অদক্ষ, যারা সঠিকভাবে যানবাহন চালানোর প্রশিক্ষণ নেয়নি। শিশু-কিশোর ও অন্য পেশা থেকে আসা শ্রমিকরাই মূলত এসব চালনা করছে। তাদের চালনার ধরন দেখে বোঝাই যায়, তারা কেবল গতির নেশায় মত্ত, ট্রাফিক আইন বা যাত্রী নিরাপত্তার কোনো তোয়াক্কা তারা করে না। ফলে প্রতিনিয়ত রাস্তায় ঘটে যাচ্ছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।
অনেক চালক আবার মাদকাসক্ত অবস্থায় রিকশা চালাচ্ছে। ফলে তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দুর্বল থাকে, যা দুর্ঘটনার হার আরও বাড়িয়ে তুলছে। এমনকি, অনেকে প্রতিবন্ধী সেজেও এই যান চালাচ্ছে, যা ট্রাফিক শৃঙ্খলার জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি স্থানে অবৈধ গ্যারেজ থেকে এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা পরিচালিত হচ্ছে। বহদ্দারহাট, বাকলিয়া বাস্তহারা, চকবাজার, অলঙ্কার, ফ্রিপোর্ট, টাইগারপাসসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে এসব গ্যারেজ। এখান থেকে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে কয়েক হাজার ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হয় প্রতিদিন। পুলিশ ও প্রশাসনের নীরব ভূমিকা এই অবৈধ কার্যক্রমকে আরও উৎসাহিত করছে।
ব্যাটারিচালিত রিকশার বিষয়ে উচ্চ আদালত স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা দিলেও কিছু অসাধু ব্যক্তি এই যানবাহনের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা নিয়মিত এই রিকশাগুলো রাস্তায় নামিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আয় করছে। অন্যদিকে, সাধারণ নাগরিকরা পড়ছে মারাত্মক দুর্ভোগে।
চট্টগ্রাম নগরীতে যানজট ও দুর্ঘটনার হার কমাতে হলে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। প্রশাসনকে কঠোরভাবে অভিযান চালিয়ে এই অবৈধ যানবাহন বন্ধ করতে হবে। বিদ্যুৎ চুরি রোধে অবৈধ গ্যারেজগুলো শনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
একই সঙ্গে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আরও কঠোর করতে হবে। পথচারী ও যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এসব ভয়ঙ্কর যানবাহন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। অন্যথায়, ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য নগর জীবনের স্বাভাবিক গতি সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ করে দেবে।
এই প্রসঙ্গে সিএমপির ট্রাফিক ডিপার্টমেন্টের একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
একই প্রসঙ্গে সমাজকর্মী ও আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ হোসাইনী সময়ের কণ্ঠস্বর'কে বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য প্রতিনিয়ত নগরবাসীর জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, যানজট সৃষ্টি, অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহার এবং ট্রাফিক আইন ভঙ্গের কারণে এই যানবাহন এখন শহরের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। প্রশাসনের উচিত দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে নগরবাসী একটি নিরাপদ ও শৃঙ্খলিত পরিবহন ব্যবস্থা উপভোগ করতে পারে। এখনই যদি উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে চট্টগ্রামের সড়ক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
এসআর