আদিবাসী সংজ্ঞা খোঁজার সাথে সাথে এই অঞ্চলে আদিবাসী যদি বলতেই হয়, আসলে কারা সেই আলাপ দিয়ে আজকের আলোচনা শুরু করা যাক।
♣প্রথমেই সংবিধান অনুসারে পাহাড়ি আদিবাসী দাবী করা নাগরিকদের পরিচয় ক্লিয়ার করা দরকার।আদিবাসী নিয়ে বিতর্কে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সমাধান দেয়া হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬ এর ২ ধারা মতে, জাতি হিসেবে বাঙালি ও নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি বলে বিবেচিত হবে। এছাড়া বাঙালি ব্যতীত অন্যান্য যারা আছে তারা উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে পরিচিত হবে। বাংলাদেশে বসবাসরত কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজেদের আদিবাসী স্বীকৃতির দাবি করলেও তা অস্বীকৃত।
♣আভিধানিক ও নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসী মানে আদিবাসিন্দা। আদিবাসী শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ Indigenous people। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ লুই মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, ‘কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই। আদিবাসী শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ indigenous যার অর্থ the people regarded as the original inhabitants of an area(Oxford Advanced Learner’s Dictionary) .
নৃতত্ত্ববিদ লুই মর্গান মনে করেন.“The aboriginals are the groups of human race who have been residing in a place from time immemorial. They are the sons of the soil”এখন প্রশ্ন পার্বত্যচট্টগ্রামে যাদের অধিবাস তারা কি ভুমিপুত্র হিসেবে দাবি করতে পারে? যদি না পারে তাহলে তারা আদিবাসী হয় কীভাবে? এই প্রশ্ন জানার স্বার্থে আপাততঃ ইন্ট্রোতে রেখে গেলাম।
♣আদিবাসী বিষয়ে আভিধানিক সংজ্ঞার বাইরে জাতিসংঘের তরফ থেকে একটি সংজ্ঞা আমরা পেয়ে থাকি। এ বিষয়ে জাতিসংঘ ও এর অধিভূক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত প্রধানত: তিনটি চার্টারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এগুলো হলো:
১)১৯৫৭ সালের ৫ জুন অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের অধিভূক্ত প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ৪০তম অধিবেশনে প্রদত্ত- Indigenous and Tribal Populations Convention, 1957 (No. 107),
২)আইএলও’র ১৯৮৯ সালের ৭ জুন অনুষ্ঠিত ৭৬তম অধিবেশনে প্রদত্ত-Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169) , এবং
৩)২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে The United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples.
এখানে আইএলও’র প্রথম চার্টার দুটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চার্টার দুটির শিরোনাম হচ্ছে- Indigenous and Tribal Populations Convention . অর্থাৎ আদিবাসী ও উপজাতি জনগোষ্ঠী বিষয়ক কনভেনশন। অর্থাৎ এই কনভেনশনটি আদিবাসী ও উপজাতি বিষয়ক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। কনভেনশনে পাস হওয়া ধারাগুলো একই সাথে আদিবাসী ও উপজাতি নির্ধারণ ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। শুধু আদিবাসীদের নয়। অথচ বাংলাদেশে এই চার্টারকে আদিবাসীদের জন্য এক্সক্লুসিভ করে উপস্থাপন করা হয়।
এখানে উপজাতি ও আদিবাসীদের জন্য আলাদা সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে।- Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169)– এর আর্টিকল ১ এর (a)তে ট্রাইবাল বা উপজাতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘tribal peoples in independent countries whose social, cultural and economic conditions distinguish them from other sections of the national community, and whose status is regulated wholly or partially by their own customs or traditions or by special laws or regulations’’. অর্থাৎ একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচলিত তাদেরকে উপজাতি বলা হয়।
এখন আইএলও’র এই সংজ্ঞাটি যদি আমরা বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, সাঁওতাল ও অন্যান্য সাবস্পেসিসসমূহের সাথে বিচার করি তাহলে পরিষ্কার বোঝা যায় এরা উপজাতি। কিন্তু বাংলাদেশের মতলববাজ বুদ্ধিজীবীরা আইএলও কনভেনশনের আর্টিকল ১-এ্র উপস্থাপিত ট্রাইবাল ডেফিনেশনটি সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে শুধু ইনডিজিন্যাসের সংজ্ঞাটি উপস্থাপন করে।
♣বলে রাখা ভালো যে, Indigenous and Tribal Populations Convention, 1957 (No. 107)- ১৯৫৭ সালে পাস হলেও এ পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ২৭টি দেশ এই কনভেশন র্যাটিফাই করেছে। ১৯৭২ সালের ২২ জুন বংলাদেশ এটি রেটিফাই করে। অন্য দিকে Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169)- – ১৯৮৯ পাস হলেও এখন পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ২২টি দেশ এই কনভেনশন রেটিফায় করেছে।উপমাহদেশের একমাত্র নেপাল ছাড়া আর কোনো দেশ এই কনভেনশন রেটিফায় করেনি।
বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সমতলের বিভিন্ন জায়গায় যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বসবাস করেন তারা আদিবাসী কিনা সে বিতর্ক বেশ পুরনো।সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা এবং সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বসবাস করে ,সেখানে বসবাসকারী ১৩ টি উপজাতির সবাই বহিরাগত ও অভিবাসিত।পার্বত্য চট্রগামে ছাড়াও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে আরো ১৬ টি উপজাতীয় জনগোষ্ঠী রয়েছে। তারা কখনোই শোষণ – বঞ্চনার কিংবা ধর্মীয় কারনে নিগৃহীত হবার অভিযোগ তোলেনি। আদিবাসীর দাবি শুধু পাহাড়েই কেন তাহলে? উদ্দেশ্য একটাই স্বাযত্বশাসন। স্বায়ত্বশাসনের যে দাবী করছে তার অন্য নাম স্বাধীনতা।তারা তাদের জাতি সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাচ্ছে।অথচ তারা কোন জাতি নয়।এদের প্রভু বিৃটিশ সরকার তাদেরকে “উপজাতি” বলে চিহ্নিত করে গেছে।এদের পুর্ব পুরুষরা কেউ এর বিরোদ্ধে কথা বলেনি।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সমুহের আনাগোনা শুরু হয় ষোল শতক থেকে। এ সময়ে আসামের মিজোরাম থেকে কুকি নামের উলঙ্গ জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। একই সময়ে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী খাগড়াছড়ি এলাকায় বন কেটে বসনত গড়ে এবং জুম চাষ শুরু করে।১৬৬০ এর দিকে অর্থাৎ সতের শতকের মাঝামাঝি চাকমাদের একটি দল আদিবাস আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে রামু থানার অদুরে সাময়িক অবস্থান নেয়। তারা পরে আরও গহিন অরণ্য আলী কদমের দিকে এবং রাঙামাটির দিকে যায় স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য। মগ বা মারমা জনগোষ্টীর অভিবাসন ঘটে ১৭৮৪ দিকে প্রায় একই সময়ে বোমাঙদের ও আগমন ঘটে।মোটামুটিভাবে বলা যায় পাব্র্ত্য চট্টগ্রামে যে ক্ষুদ্র জাতিসসত্বা সমুহের অধিবাস তাদের অভিবাস হয়েছিল ১৬ থেকে ১৮ শতকের মধ্যে। এর বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে আরও আটটি ক্ষুদ্র জাতি। তাদের কোনো কোনোটি চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদেরও পূর্ব থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করছে। সংখ্যায় নগণ্য হলেও তাদের পৃথক নৃতাত্ত্বিক সত্ত্বা দৃশ্যমান। চাকমারা কোথা থেকে এখানে এসেছে এবং এদের উৎপত্তিই-বা কোথায়, এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই মনে আসে। চাকমা জাতি যে এককালে ব্রক্ষ্মদেশে ছিল, সে সম্বন্ধে কর্নেল ফেইরী আলোকপাত করেছেন।ব্রক্ষ্মদেশে পুরাবৃত্ত ‘চুইজং ক্য থং’ এবং আরাকান কাহিনী ‘দেঙ্গাওয়াদি আরেদফুং’ নামক গ্রন্থদ্বয়েও অনুরূপ উল্লেখ রয়েছে।
♣পরিচয়ের বিচারেই উপজাতিরা আদিবাসী হিসাবে টেকেনা।সেটা যেই ডেফিনশনে হউক।হউক নৃতাত্ত্বিক বা জাতিসংঘের ডেফিনেশনে। যদি নৃতাত্ত্বিক ভাবে ঐতিহাসিক মানদন্ডে বিচার করি তাহলে বাঙালিদেরকেই বরং বলতে হবে আদিবাসী।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান লোকসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই বাঙালি এবং বাকি অর্ধেক বিভিন্ন মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীভুক্ত উপজাতীয় শ্রেণীভুক্ত। একথা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য আদিকাল থেকে এ অঞ্চলে উপজাতি জনগোষ্ঠীর বাইরের ভূমিপুত্র বাঙালিরা বসবাস করে আসছে। তবে জনবসতি কম হওয়ায় বিভিন্ন ঘটনার বা পরিস্থিতির কারণে আশপাশের দেশ থেকে বিভিন্ন ুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন এসে বসতি স্থাপন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি জাতি বহির্ভূত অন্য সকল উপজাতীয় গোষ্ঠীই এখানে তুলনামূলকভাবে নতুন বসতি স্থাপনকারী। এখানকার আদিম জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ম্রো, খ্যাং, পাংখো এবং কুকিরা মূল ‘কুকি’ উপজাতির ধারাভুক্ত। ধারণা করা হয়, এরা প্রায় ২শ’ থেকে ৫শ’ বছর আগে এখানে স্থানান্তরিত হয়ে আগমন করে। চাকমারা আজ থেকে মাত্র দেড়শ’ থেকে ৩শ’ বছর পূর্বে মোগল শাসনামলের শেষ থেকে ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে মায়ানমার আরকান অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে (Lewin 1869)। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ এবং ব্রিটিশ প্রশাসক টি. এইচ. লেউইন-এর মতে, “A greater portion of the hill tribes at present living in the Chittagong Hill Tracts undoubtedly come about two generations ago from Aracan. This is asserted both by their own traditions and by records in Chittagong Collectorate”. (Lewin, 1869, p. 28)। পার্বত্য অঞ্চলের মারমা বা মগ জনগোষ্ঠী ১৭৮৪ সনে এ অঞ্চলে দলে দলে অনুপ্রবেশ করে এবং আধিপত্য বিস্তার করে (Shelley, 1992 and Lewin, 1869)। এরা ধর্মে বৌদ্ধ মতাবলম্বী। এরা তিনটি ধারায় বিভক্ত। যেমন : জুমিয়া, রোয়াং ও রাজবংশী মারমা। চাকমাদের কল্পিত গৌরব নিয়ে আজগুবি ইতিহাস রচনাকারী বিরাজ মোহন দেওয়ান “চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত” শীর্ষক গ্র্ন্থে চাকমাদের আদি বাসস্থান তথা শিকড় সন্ধান করতে গিয়ে চাকমা ঐতিহাসিকগণ চম্পাপুরী বা চম্পক নগর রাজ্যের যে ফিরিস্থি দিচ্ছেন তার পিছনে কোন ঐতিহাসিক প্রমান নেই। বিরাজ মোহন কমপক্ষে ভারতের ৫ টি স্থানের নাম চম্পক নগর বলে উল্লেখ করেছেন।বস্তুত: চাকমারা একটি অজ্ঞাত স্থানের পাহাড়ী যাযাবর জাতি, যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভুখন্ডে আশ্রয় নিয়েছিল।আবার বিভিন্ন ভুখন্ড হতে বিতাড়িত হয়েছিল।চাকমা বুদ্ধিজীবিদের মতে তারা কখনো হিমালয়ের পাদদেশে, কখনো ত্রিপুরায় কখনো সিলেটে কখনো বার্মায় বসবাস করেছিল।সুতরাং চাকমারা বাংলাদেশের আদিবাসী নয়, বরঞ্চ আশ্রিত, বহিরাগত।একথা বিরাজ মোহন স্বীকার করেছেন। “ব্রক্ষ রাজশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে চাকমারা সেখানে শক্তিহীন হয়ে পড়ে এবং অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মানবিক কারনে চট্টগ্রামস্থ সুবেদারের অনুমতি সাপেক্ষে সর্ব প্রথম তৈনছড়ি নদীর তীরে বসবাস শুরু করে।
ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের যে প্রাচীন মানচিত্র সেখানে বাঙালিরা সুপ্রাচীন কাল থেকেই বসবাস করতো। এর বাইরেও মোগল আমলে, ব্রিটিশ আমলে বাঙালিদের সেখানে গমনের ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে ১৯০০ সালের শাসন বিধি পাস হওয়ার পর বাঙালিদের আর সেখানে গিয়ে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ ছিল না।
♣আদিবাসীরা তাহলে কোন যুক্তিতে স্বীকৃতি চাচ্ছে? তাদের সমস্ত যুক্তিকে একযোগে বললে নিচের কয়েকটি বিষয় দাড়ায়।
১) সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের চেয়ে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও রীতি-নীতি আলাদা।সেদিক থেকে তারা আদিবাসী। কে আগে এসেছে কে পরে এসেছে সেটা বিষয় না। তাহলে নৃবিজ্ঞানের সমস্ত সংজ্ঞা ও জাতিসংঘের ডেফিনিশনের কি হবে? অধিকার চাচ্ছে জাতিসংঘ চার্টার অনুসারে পরিচয় দিচ্ছে নিজের মতো তাতো হয়না।
২)আদিবাসী মানে হচ্ছে - মূলধারা থেকে যাদের ভাষা ভিন্ন এবং সংস্কৃতি ভিন্ন তাদেরকে আদিবাসী বলে। সে হিসেবে নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করছে। বুঝলাম তাহলে উপজাতি কারা? মুলধারা থেকে আলদা বলেইত আন্তর্জাতিক আইন তাদের উপজাতি বলছে।
৩) ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি শব্দগুলো বৈষম্যমূলক। তাহলে বৈষম্য একদম না থাকে মতো বাঙ্গালী হওয়ার আন্দোলন কটেন।
♣আন্তর্জাতিক আইন ও সার্বভৌমত্বের বিচারে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্যেও খুব স্পষ্ট। এখানে কোন হেরফের নেই। সরকারেরআদিবাসী হিসাবে পাহাড়িদের অস্বীকারে পেছনে যুক্তিগুলো হল:-
১) এখানকার মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি চার হাজার বছরের পুরনো। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা সেটিই প্রমাণ করে।কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবারত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ১৬ শতকে মিয়ানমার এবং কম্বোডিয়া থেকে আসা শুরু করে। সেজন্য তারা সেখানকার আদিবাসী নয় বলে সরকার মনে করছে।
২) আদিবাসী হতে হলে কলোনিয়াল কিংবা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কলোনাইজেশন হতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে সে ধরনের কিছুই হয়নি। অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকায় যাদের আদিবাসী বলা হয়, তাদের ক্ষেত্রে যে ধরনের পরিস্থিতি হয়েছিল বাংলাদেশে সে রকম কিছু হয়নি।
৩) ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত শান্তি চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে 'উপজাতি অধ্যুষ্যিত অঞ্চল' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সরকার বলছে, সে চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলের নেতারা উপজাতি শব্দটি মেনে নিয়েছে।
৪) জাতিসংঘের কোন দলিলে 'আদিবাসীর' সর্বসম্মত সংজ্ঞাও নেই বলে মনে করে বাংলাদেশ সরকার।যে ঘোষণাপত্র ২০০৭ সালে গৃহীত হয়েছিল সেখানে 'আদিবাসীদের' অধিকারের কথা বলা হলেও 'আদিবাসীদের' কোন সংজ্ঞা দেয়া হয়নি।
♣কেন উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিরা আদিবাসী হতে চাইছে তার উত্তর খুব পরিষ্কার হয় তাদের বিভিন্ন সময়ের কর্মকাণ্ডে, সভা সমাবেশে বক্তৃতায়। তবুও জাতিসংঘের ঘোষনাপত্রে কি অধিকার আদিবাসীদের দেওয়া হয়েছে সুগুলো দেখে আসলেই তাদের উদ্দেশ্য আরো পরিষ্কার হবে। সেই ঘোষণাপত্রে ১২টি ক্ষেত্রে আদিবাসীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল জাতিসংঘ। সে ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে:
*ভূমি ও ভূখণ্ডের অধিকার
*আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি ও ভূখণ্ডের উপর সামরিক কার্যক্রম বন্ধের অধিকার
*তাদের ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ প্রক্রিয়া থেকে রেহাই পাবার অধিকার
•তাদের সম্মতি ছাড়া যেসব ভূমি, ভূখণ্ড এবং সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে সেগুলো পুনরুদ্ধার ও ফেরত পাবার অধিকার।
* আত্বনিয়ন্ত্রনের অধিকার।
*অন্যান্য।
যদি তাদেরকে আদিবাসী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাহলে তারা মোটাদাগে কিছু অধিকার চাইতে পারবে যেমন:-
১. ভূমি অধিকার,
২. আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার,
৩. স্বায়ত্তশাসন অধিকার,
৪. জাতীয়তা লাভের অধিকার,
৫. জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ।
বাংলাদেশ সরকার মনে করে সীমান্ত এলাকা হওয়ায় নিরাপত্তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সে এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতাও রয়েছে।আদিবাসীদের অধিকার'' মেনে নিলে সামরিক তৎপরতাও সেখান থেকে গুটিয়ে নিতে হবে।যদি সামরিক তৎপরতা গুটিয়ে নিতে হয় তাহলে পাহাড়িরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে যে বিচ্ছিন্ন সার্বভৌমত্ব গঠনের চিন্তা করতেছে তাতে সফল হবে। যার কারণে তারা অলরেডি আদিবাসী হিসাবে অধিকার চাওয়া শুরু করে দিয়েছে। তারা স্লোগান দিচ্ছে।
*এক দুই তিন চার
বাঙ্গালিরা পাহার ছাড়।
* সেনাবাহিনীর আস্তানা
জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও।
পরিশেষে বলা যাক, পাহাড়িরা আদিবাসী স্বীকৃতি নিয়ে আগে কথা বললও মূলত বেশি সোচ্চার হয়েছে ২০০৭ সালের জাতিসংঘের ঘোষনাপত্রের পর। তারা আত্বনিয়ন্ত্রনের অধিকার চায় মূলত। যেটা স্বীকৃত হলে মএকটা জাতি স্বাধীনতা দাবি করতে পারে। যেটা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য চরম হুমকির। সেটাকি বাঙ্গু শাহবাগী ও আওয়ামীয় সমতলীয় সুশীলরা বুঝেনা? অবশ্যই বুঝে। তারা আমার আপনার চেয়ে বেশি বুঝে। তারা বুঝে বলেই আদিবাসী ও উপজাতি বিষয়ক কনভেনশন থেকে শুধু আদিবাসীর সংজ্ঞা শুনায় আমাদের। কারণ উপজাতির সংজ্ঞাসহ বললে যে তাদের ভণ্ডামি ধরা পড়ে যাবে।
লেখক পরিচিতি: তৌহিদুল ইসলাম। লেকচারার ,আইন বিভাগ। বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।