নারীরা প্রায়শই লজ্জা ও সংকোচের কারণে বেশ কিছু অসুখ সম্পর্কে পরিবারের কাছে তথ্য গোপন করেন। দেখা যায় খুব জটিল পরিস্থিতি হলে তখনই সেটি প্রকাশ পায়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী পুরুষেরাও অনেক সময় তাদের নানা অসুখ সম্পর্কে লজ্জা বোধ করেন এবং তথ্য গোপন করেন।
চিকিৎসকেরা বলছেন, এর বেশিরভাগই প্রজননতন্ত্রের নানা অসুখ। অণ্ডকোষের নানাবিধ সমস্যা, যৌন দুর্বলতা, ফিস্টুলা, গাইনোকোমেশিয়া বা পুরুষের স্তন বৃদ্ধি এর মধ্যে কয়েকটি।
ঢাকার সাবিনা ইয়াসমিন (ছদ্মনাম) একদিন হঠাৎ খেয়াল করছিলেন তার স্বামী ঠিকভাবে বসতে পারছেন না। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কিছু একটা তার জন্য বেশ ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘‘প্রথমে আমাকে জানালো যে তার পায়ুপথের কাছে একটা ফোঁড়া হয়েছে। তখন আমি দেখতে চাইলে ও রাজি হল না। যখন দেখছি যে ও খুব কষ্ট পাচ্ছে তখনও সে আমাকে দেখতে দেয় না। এরকম বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে। এরপর এক রকম জোর করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। সে তখনও আমাকে ডাক্তারের চেম্বারের মধ্যে ঢুকতে দেয়নি।’’
সাবিনা ইয়াসমিন পরে জানতে পারলেন তার ৫০ বছর বয়সী স্বামীর পায়ুপথে ফিস্টুলা হয়েছে। পায়ুপথের কাছে নিতম্বের একটি অংশে সুড়ঙ্গের মতো হয়েছে। সেটি মিশে গেছে পায়ুপথের সাথে। সেখানে রীতিমতো পুঁজ জমে গেছে। এই সমস্যার চিকিৎসায় তিন ধাপের অস্ত্রোপচার দরকার হয়েছে। দশ দিন পরপর মোট তিনবার করা অস্ত্রোপচারে খরচ হয়েছে ছয় লাখের মতো।
সাবিনা ইয়াসমিন বলছেন, ‘‘প্রতিবার অপারেশনের পর একটা মোটা গজ কাপড় ঝুলে থাকতো সুড়ঙ্গটার মুখ থেকে। চিন্তা করেন তিন চার ইঞ্চি মাংসের মধ্যে ঠেসে গজ কাপড় ঢুকানো। প্রথমবার জায়গাটা আমার দেখার সুযোগ হয়েছে যখন অপারেশনের পর ড্রেসিং পরিষ্কার করার দরকার হয়েছে। আমি ওর স্ত্রী। আমাকেও কি একটু জানাবে না? সময়মত জানলে একটু গুগল করতে পারতাম। তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে যেতে পারতাম। তাহলে বিষয়টা এত খারাপ অবস্থায় যেত না।’’
অণ্ডকোষের নানাবিধ সমস্যা
ইউরোলজিস্ট ডা. ফজল নাসের অণ্ডকোষের কয়েকটি অসুখ সম্পর্কে ধারণা দিলেন। হাইড্রোসিল, যাতে অণ্ডকোষের বাইরের দিকে পানি জমে, অণ্ডকোষ ফুলে যায়। প্রদাহ অথবা আঘাতের কারণে এটি হতে পারে। অণ্ডকোষের দুই পাশে, অথবা একপাশেও এটি হতে পারে।
হার্নিয়া হলে মনে হবে পেটের ভেতর থেকে নাড়ি বের হয়ে আসতে চায়। হাঁচি, কাশি দিলে অথবা জোরে হাঁটলে মনে হবে তলপেটের নিচ থেকে কিছু একটা অণ্ডকোষের ভেতরে চলে আসতে চাচ্ছে। অণ্ডকোষকে ঝুলে থাকতে সাহায্য করে, বলা যেতে পারে তারের মতো এই অংশটি অণ্ডকোষের সাথে পেঁচিয়ে গেলে তাকে বলা হয় টেস্টিকুলার টরশন। পেট থেকে যে রক্তনালী অণ্ডকোষের সাথে সংযুক্ত থাকে সেটা ফুলে যেতে পারে, দেখতে কৃমির মতো মনে হতে পারে, যাকে বলা হয় ভেরিকোসিল।
টেস্টিকুলার সিস্ট হলে মনে হবে দুটি অণ্ডকোষের সাথে নতুন আরও অণ্ডকোষ গজিয়েছে। তিনি বলছেন, অণ্ডকোষের বেশিরভাগ সমস্যায় অঙ্গটি ফুলে যাওয়া একটি লক্ষণ। বেশিরভাগ সমস্যায় ব্যথা হতে পারে।
ডা. নাসের বলছেন, ‘‘অণ্ডকোষের সমস্যা নিয়ে তখন অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাবেন যখন খেয়াল করবেন যে অণ্ডকোষের অনুভূতি চলে গেছে। অণ্ডকোষে হাত দিলে, এমনকি উরুতেও একটু ঘষা লাগলে পুরুষদের এক ধরনের অনুভূতি হয়। সেই অনুভূতি যখন বোধ করবেন না এবং আস্তে আস্তে অণ্ডকোষ ফুলে যাচ্ছে, এই দুটো সমস্যা খেয়াল করলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাবেন। কারণ এটি ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।’’
গাইনোকোমেশিয়া
৩৫ বছর বয়সী একজন তরুণ, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার এক বাসিন্দা বলছেন, যখন কৈশোরে পা দিয়েছেন তখন বুকের কাছে মেয়েদের স্তনের মতো কিছু একটা প্রথম খেয়াল করেন। বাড়ির কর্মচারীদের একজন বিষয়টার প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, যে ছেলেদের এমন হওয়ার কথা না। এরপর থেকে বাকি জীবন পরণে পোশাক ছাড়া তাকে দেখেছেন শুধু ঘনিষ্ঠ কয়েকজন।
‘‘একটা অ্যাফেয়ার ছিল আমার কলেজ লাইফে। যার সাথে অ্যাফেয়ার ছিল, সেই ভদ্রমহিলা অনেক সময় এটা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতো যে আল্লাহর তো তোকে আসলে মেয়ে বানানোর কথা ছিল, ভুলে ছেলে বানাইছে।’’
‘‘বাংলাদেশে যেটা হয় যে পুরুষরা খালি গায়ে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু আমি সেটা কখনোই পারতাম না। ম্যাট্রিকে যখন পড়ি, তখন থেকে আমার পুরো লাইফে ঘনিষ্ঠ দু-একজন ছাড়া আমাকে খালি গায়ে কেউ দেখেনি।’’
যে অসুখটি সম্পর্কে তিনি বলছেন তার নাম গাইনোকোমেশিয়া বা পুরুষদের স্তন বৃদ্ধি। সে সম্পর্কে তার এই সংকোচের কারণ সম্পর্কে তিনি বলছিলেন, ‘‘নরমালি আমরা যেটা দেখে অভ্যস্ত তার বাইরে আমরা যদি কিছু দেখি তাহলে সেটা আমাদের মধ্যে একটা সংকোচ তৈরি করে। পুরুষ মানুষের চেস্ট যেরকম থাকার কথা আমার সেরকম না এটা হয়ত আমার সংকোচের কারণ”।
“আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে যখন থাকতাম তখন আমার রুমমেটরা খালি গায়ে বসে থাকতো। তারা আমাকে বলতো, অনেক গরমকালেও কেন আমি শার্ট পরে বসে আছি। আমার সংকোচটা ছিল ওরা আমাকে নিয়ে হয়ত হাসাহাসি করবে। কলেজের বান্ধবী যখন খোঁটা দিছিল তখনও একটু লজ্জা পাচ্ছিলাম।”
এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ডা. মুস্তাফা কায়সার বলছেন, গাইনোকোমেশিয়া হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে সৃষ্ট একটি অসুখ। সাধারণত কিশোর বয়সে শুরু হয়ে কিছুদিন পর এমনিতেই সেরে যায়।
তিনি বলছেন, “সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালে গাইনোকোমেশিয়া হয়। উভয়-পাশে বা একপাশে এটি হতে পারে। সাধারণত এতে ব্যথা থাকে। বেশিরভাগ সময়ে এটা আগের অবস্থায় ফিরে আসে। যদি এটা তিন সেন্টিমিটারের বেশি বড় হয়, আমরা হরমোন চিকিৎসা দিয়ে থাকি। এটি ক্যান্সার বা অন্য কোন শারীরিক জটিলতা তৈরি করে না। তবে ছয় মাসের বেশি সময় থাকলে এটি আর ভাল হয় না। বয়স বেড়ে যাওয়ার পর যদি কেউ অস্বস্তি বোধ করেন তাহলে খুব সহজ অস্ত্রোপচার করে এটি অপসারণ করা যায়।”
ইরেক্টাইল ডিসফাংশন ও প্রিম্যাচিওর ইজাকুলেশন
ডা. ফজল নাসের বলছেন, যে সমস্যায় পুরুষরা সবচেয়ে বেশি সংকোচবোধ করেন তা হল যৌন মিলনের সময় পুরুষাঙ্গ শক্ত না হওয়া যাকে বলে ইরেক্টাইল ডিসফাঙ্কশন। সঙ্গম শুরু করার পর খুব দ্রুত বীর্যপাত হওয়া এটিকে বলা হয় প্রিম্যাচিওর ইজাকুলেশন।
তিনি বলছেন, “বেশিরভাগ পুরুষ জীবনে কোন না কোন সময় এটির মুখোমুখি হয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাদের কোন শারীরিক সমস্যা রয়েছে। অনেক সময় ক্লান্তি, উদ্বেগের কারণে সাময়িক সমস্যা হতে পারে। তবে কারো যদি নিয়মিত এই সমস্যা হয় তাহলে তার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।”
যৌনাঙ্গের রক্তনালী সরু হয়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, হরমোনজনিত সমস্যা, কোন ঔষধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এই সমস্যার কারণ হতে পারে। ডা. নাসের বলছেন, এই সমস্যা দুটি বেশিরভাগ সময় চিকিৎসায় ভালো হয়ে যায়।
সংকোচের পেছনে যে কারণ থাকতে পারে
শারীরিক কষ্ট ও নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকা স্বত্বেও পুরুষেরা কেন তাদের কিছু অসুখের কথা গোপন করেন? মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ইশরাত শারমিন রহমান বলছেন, নারী ও পুরুষের অসুখ নিয়ে লজ্জার কারণ দুই রকম এবং বিষয়টি সামাজিকভাবে শিক্ষার একটি ফল। তার মতে পুরুষেরা দুর্বল হবে না, তার যৌনতা তার শক্তির উৎস সামাজিকভাবে পুরুষদের এমন শিক্ষা দেয়ার কারণে তারা এসব অসুখকে তারা পুরুষত্বের উপরে আঘাত মনে করে।
তিনি বলছেন, “তারা ফিল করে যে যদি তারা কথা বলে তাহলে তাদের দুর্বল মনে করা হতে পারে। তাদের যে পুরুষত্ব সেটার উপরে একটা আঘাত মনে করে। তার অনেক সময় তারা মনে করে যে তার প্রিম্যাচিওর ইজাকুলেশনের সমস্যা বা ইরেক্টাইল ডিসফাংশন আছে এই বিষয়টি যদি কারো সাথে শেয়ার করে তাহলে সে তাদের কাছে ছোট হবে।”
“অনেক সময় দেখা যায় তারা ভাবে শেয়ার করলে বুলিং করবে হাসাহাসি করবে, পুরুষত্বে সমস্যা আছে বলে লেবেল করবে। পুরুষরা ভাবে যে সেক্সুয়াল বিষয় তাদের শক্তির উৎস। এই বিষয়ে সামর্থবান না হতে পারলে তাদের পুরুষালী ধারনা ও ইগো আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এমনকি স্ত্রীরাও খোঁটা দিয়ে থাকে এসব কারণে তারা লজ্জা বা সংকোচ বোধ করে।”
ডা. ইশরাত শারমিন রহমান বলছেন, পুরুষদের এসব সমস্যার সমাধানে সামাজিকভাবেই তার শিক্ষার পরিবর্তন দরকার। তবে তিনি মনে করেন তার সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন তার স্ত্রী ও সঙ্গী। যাদের পক্ষে সমস্যা আঁচ করা অন্যদের চেয়ে সহজ।
তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন যে দোষারোপ ও বিদ্রূপ না করে সঙ্গী যদি বরং তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে মানসিক সমর্থন জোগায় সেটি হবে অসুখটি সারিয়ে তোলার অনেক বড় একটি ধাপ।
চার ধরণের চিকিৎসক
পুরুষদের যেসব সমস্যার কথা এই লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে তার অনেকগুলোর চিকিৎসার জন্য ইউরোলজিস্টের কাছে যেতে হয়। যেমন অণ্ডকোষের নানাবিধ সমস্যা, ইরেক্টাইল ডিসফাঙ্কশন, প্রিম্যাচিওর ইজাকুলেশন, হার্নিয়া ইত্যাদি। অণ্ডকোষের কিছু সমস্যা ও হার্নিয়ার জন্য যদি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয় তাহলে সার্জিকাল স্পেশালিষ্ট দরকার হবে। ইউরোলজিস্ট চিকিৎসার পরবর্তী ধাপগুলো সম্পর্কে জানিয়ে দেবেন। গাইনোকোমেশিয়া চিকিৎসা দেন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ও হরমোন বিশেষজ্ঞ। যদি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে সার্জিকাল স্পেশালিষ্ট। দেশের যেকোনো সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই চার ধরনের চিকিৎসক রয়েছেন।